হ্যাপি আখন্দ : পাহাড়ি ঝর্ণার ছন্দে বাজতো যার গিটার ও গান


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: December 28, 2022 16:26:02 | Updated: December 29, 2022 12:41:47


হ্যাপি আখন্দ চমৎকার বাজাতেন গিটার, পিয়ানো, কি বোর্ড,  ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

'আমার প্রাণ যে মানে না, কিছুই ভালো লাগে না / কে বাঁশি বাজায় রে, মন কেন না চায় রে'- এই গানটি গিটার হাতে গাইছেন এক তরুণ। পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। তারপর সেই গানে আমরা দেখি রাইসুল ইসলাম আসাদ ও নায়লা আজাদ নুপুরকেও৷ অনেকেরই হয়ত দৃশ্যটি মনে থাকবে। ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া 'ঘুড্ডি'  সিনেমার গান এটি। তখন সেই তরুণের বয়স সবে কুড়ি বছর।

সাত বছর আগের কথা। মাত্র তেরো বছরের এক কিশোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সেই কিশোরই কিবোর্ড বাজাচ্ছে স্পন্দন ব্যান্ডের সঙ্গে। তার বাজানো মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললো দর্শকদের। সেদিনের সেই কিশোর ও ঘুড্ডি সিনেমায় দেখা সেই তরুণের  নাম হ্যাপি আখন্দ।

বড় ভাই লাকী আখন্দ তখন সুরকার হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন। সময়টা ১৯৭৩ সাল৷ লাকী আখন্দ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রেও গান করেছেন৷ বড় ভাইয়ের হাত ধরেই সঙ্গীতজগতে পদার্পন হ্যাপির। খুব ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রবাদনে তার দক্ষতা চোখে পড়ে বড় ভাই লাকীর।

হ্যাপি শুনতে বেশি পছন্দ করতেন ল্যাটিন ব্লুজ ও জ্যাজ মিউজিক। লাকী আখন্দ তাকে রাশিয়ান, রোমান, গ্রীক মিউজিকও শোনান। হ্যাপির গান শোনার ক্ষেত্রে যেমন বৈচিত্র‍্য ছিলো, তেমনি ছিলো গাওয়ার ক্ষেত্রেও। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি রেকর্ড করেছিলেন 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' গানটি।

এই গান তৈরির পেছনে আছে চমকপ্রদ এক ঘটনা।

নওগাঁর জেলার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তাদের এক সম্পর্কীয় মামা। তারা এখানে আসেন। ছোট যমুনা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন লাকী, হ্যাপি৷ সন্ধ্যা নামার মুখে লাকী আখন্দের মাথায় একটি সুর আসে। সেখান  থেকেই ' চলো না ঘুরে আসি অজানাতে, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে' লাইনটা তারা ভাবেন। এরপর ঢাকায় ফিরে এস এম হেদায়েতকে লিখতে বলেন পুরোটা। সে বছরই হ্যাপি গানটি রেকর্ড করেন।

সে বছরই কোলকাতায় এক কাজে গেলে মান্না দে-কে রেকর্ডিংটা শোনান৷ তিনি জানতে চান, কে গাইছে? লাকী, হ্যাপির নাম বলার পর উনি বলেন, চমৎকার গলা, দারুণ থ্রোয়িং।

হ্যাপি বিটিভির সঙ্গীতানুষ্ঠান 'বর্ণালি' তে এই গানটি নিজের মতো ইম্প্রোভাইজ করে গান। সেটা ১৯৭৭ সালের কথা। চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। সেই অনুষ্ঠানে তিনি 'এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা' গানটিও গেয়েছিলেন। দুটোই জ্যাজ ধাঁচে করেন।

ছোটবেলায় হ্যাপি ও লাকী আখন্দ, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

এর ভেতর স্পন্দন প্ল্যাটফর্মের হয়ে বিভিন্ন গানের সঙ্গীতায়োজনও করেন তিনি। নাসির উদ্দীন আহমেদ অপুর লেখা ও সুর করা 'এমন একটা মা দে না ', ফিরোজ সাঁইয়ের 'এক সেকেন্ডের নাই ভরসা' গানগুলোর মিউজিক অ্যারেন্জ করেন তিনি। মাত্র ১৫/১৬  বছর বয়সেই।

১৯৭৯ সালে ফিরোজ রশিদের সঙ্গে মিলে হ্যাপি তৈরি করেন ব্যান্ড 'মাইলস।' ১৯৮২ সালে 'মাইলস' নামেই তাদের অ্যালবাম বাজারে আসে।  বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ ইংরেজি গানের অ্যালবাম ছিলো এটি। এরপর ১৯৮৬ সালে মাইলস এর 'আ স্টেপ ফারদার' অ্যালবামটি আসে। সেটিও ইংরেজি গানের। হ্যাপি দারুণ গিটারিস্ট ছিলেন, তবে মাইলসে মূলত কি বোর্ড বাজাতেন। ১৯৮৬ তে তিনি মাইলস ছাড়েন।

১৯৮০ সালে ঘুড্ডি সিনেমায় তার কণ্ঠে দুটি গান ছিলো - 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' ও 'কে বাঁশি বাজায় রে'। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর পরিচালনা ও আসাদ-সুবর্ণার অভিনয়ের নেপথ্যে 'আবার এলো যে সন্ধ্যা' গানটিকে চিরসবুজ করেছে হ্যাপির প্রাণপূর্ণ কণ্ঠ।

হ্যাপির গলায় ছিলো সহজাত উচ্ছ্বলতা, গিটার -পিয়ানোতে ছিলো চমৎকার দখল। তিনি গানের রিদম খুবই ভালো বুঝতেন। 'নীল নীল শাড়ি পরে' গানটিতে তার ব্লুজ ধাঁচে বাজানো অবিস্মরণীয় গিটারের সুর কিংবা 'পাহাড়ি ঝর্ণা' গানে 'যদি মানুষের মন আজ হতো সাগরের মতো, প্রশান্ত-জীবন্ত হতো' জায়গাটার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ্য। তিনি 'স্বাধীনতা তোমায় নিয়ে গানতো লিখেছি' কিংবা 'কে ওই যায় রে আলো জ্বেলে' গানগুলোতেও এই রিদম সেন্সের প্রকৃষ্ট প্রমাণ রেখেছেন। শেষোক্ত গানটিতে ব্লুজ ও র‍্যেগের ভালো সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।

নিজ সুরে তার গাওয়া  'তুমি আমার প্রথম প্রেমের গান'-এর ইন্ট্রোর গিটার সলোটি বাংলা গানের ইতিহাসের সবচেয়ে রোমান্টিক গিটার সলোগুলোর একটি। শেষদিকে আবার মনকে নস্টালজিয়ায় ভরিয়ে দেবার মতো মর্মস্পর্শী সুর বাজে গানটিতে৷

হ্যাপি আখন্দকে নিয়ে গবেষক ও লেখক গৌতম কে. শুভ বলেন, "হ্যাপী আখান্দ একাধারে সুরকার, কি–বোর্ড বাদক, গিটারবাদক, সংগীত পরিচালক; এত সব সক্রিয়তার কারণে খুব বেশি গান আমাদের জন্য রেখে যাননি। তিনি মানুষকে শেখাতে ভালোবাসতেন। এখনকার মতো তখন এই সব বাদ্যযন্ত্র শেখার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। সবাই মিলে একসঙ্গে বসে শিখতেন, অনুশীলন করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা কলকাতা—বিভিন্ন সময়ে তাঁর কাছে শিক্ষা নিয়েছেন এখনকার নামকরা অনেক মিউজিশিয়ানও। তখন যারা ব্যান্ড সংগীত চর্চা করতেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে হ্যাপী আখান্দকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। দেশের বড় সব ব্যান্ড তারকারা তাই বিভিন্ন সময়ে অকপটে স্বীকার করেছেন হ্যাপীর মাহাত্ম্য এবং শূন্যতাকে।"

হ্যাপি আখন্দের জন্মনাম ছিলো জিয়া হাসান আখন্দ হ্যাপী, ছবি: আশিক মিউজিক

হ্যাপি আখন্দ কোলকাতার প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক মধু মুখার্জিকে গিটার লেসন দিতেন।  এছাড়া আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, শাফিন আহমেদ,  জেমসসহ আরো অনেকেই লেসন ও পরামর্শ পেয়েছেন তার কাছ থেকে।

তবে সে সময়ও বাংলাদেশে রক মিউজিক ছিলো অনেকের কাছে অচ্ছুৎ, মূল্যায়নও ছিলো না। এ ধরণের গানকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেবার সুযোগও বলতে গেলে ছিলো না। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিও ছিলো প্রতিকূল।  হ্যাপি হতাশ ছিলেন। ১৯৮৭ সালের আজকের দিনের বিকেলে তাই পৃথিবী হারালো সঙ্গীতের এক বরপুত্রকে। তার মৃত্যুর পর লাকী আখন্দ সঙ্গীত থেকে অনেকটাই সরে যান। ১৯৯৮ এর পরে আবার ফিরেছিলেন অঞ্জন দত্তর অনুরোধে। ১৯৯৩ সালে হ্যাপীর সব গান একত্র করে সারগাম থেকে 'শেষ উপহার' নামে ক্যাসেট প্রকাশ করিয়েছিলেন লাকী আখন্দ৷ পরে তিনি 'হ্যাপী টাচ' নামে ব্যান্ড করেন৷  হ্যাপির ঘনিষ্ট বন্ধু প্রবাদপ্রতিম গিটারিস্ট নিলয় দাস তাকে নিয়ে গান করেছিলেন, 'হ্যাপি তোকে মনে পড়লেই।' নিজের প্রতিষ্ঠিত গিটার স্কুলের নাম রেখেছিলেন 'হ্যাপি স্কুল অভ মিউজিক।

গৌতম কে.শুভ বলছিলেন, ''হ্যাপীর চলে যাওয়া তখন যে কত বড় ধাক্কা ছিল, সেটা বোঝার জন্য হ্যাপী আখান্দের বড় ভাই আরেক নক্ষত্র লাকী আখান্দ কিংবা কিংবদন্তি গিটার মায়েস্ত্রো নিলয় দাশের দিকে তাকাতে হবে।  এখনো কাঁধে গিটার নিয়ে বোহেমিয়ান কোনো তরুণকে হেঁটে যেতে দেখলে আমাদের মনে পড়ে যায় হ্যাপী আখান্দের নাম।"

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like