হোমিনিন থেকে হোমো সেপিয়েন্স: সভান্তে প্যাবো’র নোবেল বিজয়ের গল্প


সাজিদ আল মাহমুদ | Published: October 16, 2022 16:41:09 | Updated: October 16, 2022 20:50:28


হোমিনিন থেকে হোমো সেপিয়েন্স: সভান্তে প্যাবো’র নোবেল বিজয়ের গল্প

এ বছর চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডিশ গবেষক ও জিনতত্ত্ববিদ সভান্তে প্যাবো। জীবনের বড় একটি সময় তিনি মানব বিবর্তনের বিভিন্ন ধারা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন চমকপ্রদ সব তথ্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, হারিয়ে যাওয়া মানব সম্প্রদায় ‘নিয়েন্দারথাল’ এর জিনোম সিকোয়েন্স আবিস্কার। পাশাপাশি তিনি ‘ডেনিসোভা’ নামের এক নতুন প্রজাতির হোমিনিনের সন্ধান পেয়েছেন যারা বহু আগে পৃথিবীতে বিচরণ করতো। মানব বিবর্তনের এ সকল অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানসূচক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি এই পাঁচ বিষয়ে অসামান্য অবদান রাখার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। 

সভান্তে প্যাবো জার্মানির লিপজিগে অবস্থিত ‘ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ ইভোল্যুশনারি এনথ্রোপলজি’র একজন প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৫৫ সালের ২০ এপ্রিল সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সিউন বার্গস্টর্ম ছিলেন একজন জৈব রসায়নবিদ যিনি ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সভান্তে প্যাবো ১৯৮৬ সুইডেনের উপসা’লা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ডিএনএ নিয়ে একাধিকবার গবেষণা চালিয়েছেন। নোবেল প্রাপ্তির পূর্বেও তিনি বহু সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

সভান্তে প্যাবো তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাটি পরিচালনা করেন ২০১০ সালে, জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ও তার দলবল মিলে নিয়েন্দারথাল প্রজাতির জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করে ফেলেন।

জিনোম সিকুয়েন্সিং হলো একটি প্রাণির ডিএনএ কে পুনর্বিন্যাস করা। নিয়েন্দারথালের ডিএনএ দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেগুলো à¦ªà§à¦¨à¦°à§à¦¬à¦¿à¦¨à§à¦¯à¦¾à¦¸ করা ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ।

প্যাবো’র এই আবিস্কারের ফলে হারিয়ে যাওয়া নিয়েন্দারথাল প্রজাতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে তারা কোথায় বসবাস করতো, তাদের আকার-আকৃতি কেমন ছিল, তাদের সাথে হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষের সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা ইত্যাদি।

হোমিনিন ও নিয়েন্দারথাল

হোমিনিন শব্দটি এমন প্রজাতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যারা মানুষের মত দুই পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারতো। নিয়েন্দারথাল, হোমো সেপিয়েন্স, হোমো হেইডেলবারজেনসিস, আপরাইট ম্যান, হোমো হাবিলিস ইত্যাদি কিছু হোমিনিন প্রজাতির উদাহরণ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীতে এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির হোমিনিন বসবাস করতো। বর্তমানে হোমো সেপিয়েন্স বা মানুষ বাদে সকল হোমিনিনের বিলুপ্তি ঘটেছে।

নিয়েন্দারথাল হলো একপ্রকার হোমিনিন প্রজাতির প্রাণী। এখন থেকে তিন লক্ষ বছর আগে তারা পৃথিবীতে বসবাস শুরু করেছিল। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে তারা হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। এরপর থেকে তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নিয়েন্দারথালদের অনেক ফসিল বা জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। ধারনা করা হয়, তারা বর্তমান ইউরেশিয়া অঞ্চলে বসবাস করতো।

ডেনিসোভা

সভান্তে প্যাবো দীর্ঘদিন নিয়েন্দারথালদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি নিয়েন্দারথালের জিনোম সিকোয়েন্সও আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

২০০৮ সালে একটি বিরল ঘটনা ঘটে। সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহা থেকে একটি ফসিল আবিস্কৃত হয়। প্যাবো এই ফসিলের উপর গবেষনা চালিয়ে বুঝতে পারেন এটি নিয়েন্দারথালদের ফসিল না। পূর্ববর্তী কোনো হোমিনিন এর সাথেও এর আকার-আকৃতি মিলছে না। তিনি এক নতুন প্রজাতির হোমিনিন আবিস্কার করে ফেলেছেন। গুহার নাম অনুযায়ী এই প্রজাতির নাম রাখা হয় ডেনিসোভা।

ডেনিসোভার ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করার পর আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে। নতুন এই প্রজাতিটি নিয়েন্দারথাল ও হোমো সেপিয়েন্সদের সময়ও অবশিষ্ট ছিল। ধারণা করা হয়, তারা সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে বসবাস করতো।

প্যাবো আবিষ্কার করেন, এই নিয়েন্দারথাল ও ডেনিসোভা প্রজাতির কিছু জিন মানব দেহেও বিদ্যমান রয়েছে।

এক প্রজাতির জিন আরেক প্রজাতিতে প্রবেশ করলে এই ঘটনাকে বলা হয় ‘জিন ফ্লো’। এ থেকে ধারণা করা হয়, হোমো সেপিয়েন্সদের সাথে নিয়েন্দারথাল ও ডেনিসোভানদের মিলন ঘটেছিল। পরবর্তীতে দুইটি প্রজাতিই অজ্ঞাত কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায়। টিকে থাকে শুধু হোমো সেপিয়েন্স।

প্যাবো তার গবেষণায় প্রমাণ করেন, মানব দেহে এই দুই প্রজাতির জিনের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মানব দেহে প্রায় ১ থেকে ৬ শতাংশ ডেনিসোভা জিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই জিনগুলো দেহকে ঠান্ডা পরিবেশে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে। নিয়েন্দারথালদের থেকেও ১ থেকে ৪ শতাংশ জিন মানব দেহে রয়েছে। এগুলো দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।

সভান্তে প্যাবোর এই গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা করে। ২০২০ সালে করোনাকালীন তার এই তথ্য ভ্যাক্সিন তৈরিতে সহায়তা করেছিল। এ সকল অবদানের জন্যই চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পেয়ে গেলেন সভান্তে প্যাবো।

 

সাজিদ আল মাহমুদ বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

shajidmahmud11@gmail.com

Share if you like