হাসমত: পুরান ঢাকার ৫০ বছর পুরোনো ঘুড়ির কারিগর


মো. ইমরান | Published: January 17, 2023 13:41:42 | Updated: January 18, 2023 17:03:56


ঘুড়ির কারিগর মোহাম্মদ হাসমত। ছবি: মো: ইমরান

ক্লাস ফাইভের ছাত্র ফারদিন দোকানে গিয়ে বললো হাসমতের ঘুড্ডি দিতে। দোকানী সাথে সাথেই একটি লাল সাদা চোখদার ঘুড়ি তার হাতে ধরিয়ে দিল। শুধু ফারদিন নয় তার সাথে ছোট-বড় অনেকের চাহিদা এক, হাসমতের ঘুড়ি চাই। আসছে সাকরাইনে তারা এই ঘুড়ি ওড়াবে। তারা কি জানে তাদের পছন্দের এই হাসমত ঘুড়ি কে বানায়? এর পেছনেও যে রয়েছে ৫০ বছরের গল্প?

মাইকেলদার ঘুড়ির পেছনে কারিগর মোহাম্মদ হাসমত। ছবি: মো: ইমরান

মোহাম্মদ হাসমত। তিনি পুরান ঢাকার অলিগলির ভিতরে, কলতাবাজারে ৫০ বছর ধরে ঘুড়ি বানান।

পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে বাবার সাথে খুব অল্প বয়সে ঘুড়ি বানানো শেখেন। ঘুড়ি বানানো এবং অন্যের ঘুড়ি ধরা তার কাছে ছিল আনন্দের বিষয়। 

"আমার বয়স যখন ৮-১০ বছর তখন আমি প্রথম ঘুড়ি বানাই। কাজটা বেশ আনন্দের ও শখের, কাজেই তখন থেকেই এটি পেশা হিসেবে নিবো বলে আমি সিদ্ধান্ত নেই।"

মাইকেলদার ঘুড়ি। চিত্রগ্রাহক: মো: ইমরান

হাসমত ঘুড়ির নাম কী করে হলো?

"এই ঘুড়িকে সবাই সামুর বাড়ির ঘুড়ি নামেই জানতো। আমি হাসমত যে এই ঘুড়ির কারিগর এই কথা কেউ জানতো না। কিন্তু ছেলেপেলেরা দোকানে গিয়ে  ভালো ঘুড়ি চাইলে দোকানীরা তাদের হাসমতের ঘুড়ি দিতেন । এরপর থেকে সামুর বাড়ির বদলে হাসমতের ঘুড়ি নামে পরিচিতি পেল।"

কেন সারাজীবন ঘুড়িই তৈরি করে গেলেন? 

ঘুড়ির সাথে শিশু-কিশোরদের এক আলাদা মায়া কাজ করে। যেমন: কোথায় কোনো ঘুড়ি কাটা পড়লে সেই ঘুড়িকে ধরার জন্য পেছনে পেছনে দৌড়ায় এলাকার শিশুরা। শীত এলেই আকাশ ছেয়ে যায় রংবেরঙের ঘুড়িতে। মানুষের এই হাসিখুশির অংশ হতে পেরেই নিজেকে সার্থক মনে করেন হাসমত আর; এজন্যই তিনি ৫০ বছর ধরে ঘুড়ি বানিয়ে যাচ্ছেন। 

তিনি বলেন, "আকাশ ভরা ঘুড়ি দেখতে আমার ভালো লাগে। নানান রঙের ঘুড়ি উড়িয়ে ছেলেরা আমার প্রশংসা করে। এই প্রশংসাই আমার অনুপ্রেরণা, যার জন্য ৫০ বছর হয়ে গেলেও এ পেশা ছাড়িনি।"

ঘুড়ি বানাচ্ছেন হাসমত। চিত্রগ্রাহক: মো:ইমরান

এখন আর তখনের ঘুড়ির মধ্যে কী পার্থক্য: 

"প্রথম পার্থক্য বলতে গেলে ঘুড়ির দামের। এখন যে ঘুড়ি ৩০ টাকায় বিক্রি হয় সেটি পাচঁ দশক আগে আমি ১ আনা থেকে ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করেছি," বলেন হাসমত। 

ঘুড়ির মাধ্যমে একসময় যে প্রেম নিবেদন ও চিরকুটের আদান-প্রদান হতো সেই গল্পও শোনালেন হাসমত। তিনি বলেন, "আগে ছোট কাগযে লিখে ঘুড়ির মধ্যে বেঁধে দিত ছেলেরা। ওই ঘুড়ি জানালা দিয়ে, ছাদে বাড়ির উঠানে ফেলতো। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, তাই এভাবেই যোগাযোগ করতো।" 

একসময় সাকরাইন উৎসবেকে কেন্দ্র করে এলাকার ছেলেপেলেরা ঘুড়ি ওড়াতো বলে জানান এই ঘুড়িয়াল। তিনি বলেন, "এখনের সাকরাইনে আতশবাজিই মুখ্য। ঘুড়ি উড়ায় শখে। তবে চাহিদা আগের তুলনায় বেড়েছে।" 

তবে শুধুই কি ঘুড়ির দামে এসেছে এই পরিবর্তন? নকশার কথা বললে আগের ঘুড়ির সাথে এখন বিশাল ফারাক দেখা যায়। 

"হ্যাঁ, নকশায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমি নিজেই অনেকগুলো নকশা তৈরি করেছি। যেমন আগে চোখদার, চার বোয়া বা কাউটাদার ঘুড়ি দেখা যেত। আমি এগুলোর সাথে মাইকেলদার, রকদার, লাভদার, দাবাদার এই নকশাগুলো বাজারে প্রথম এনেছি।" বলেন হাসমত।

চোখদার ঘুড়ি

রংবেরঙের ঘুড়ির নামের পেছনের গল্প: 

পুরান ঢাকাইয়্যারা কচ্ছপকে কাউটা ডাকে। চারটি বৃত্ত থাকায় ঘুড়ির নকশা অনেকটা কচ্ছপের মতো দেখায়, তাই এর নাম কাউটাদার। 

ঘুড়ির কয়েকটি অংশ ভিন্ন ভিন্ন রঙে জোড়া তালি দেয়া থাকে। এই জোড়া তালি দেয়া ঘুড়ির নাম মাইকেল। রংবেরঙের কাগজের মিশেলে এই ঘুড়ির নাম মাইকেল দেয়া হয়। 

গরুর মাথার মতো আকৃতির একটি ছাপ ঘুড়ির মধ্যখানে দেখা যায়। এই ঘুড়ির নাম কাউদার অথবা রক। এরকম লাভদার ঘুড়িতে মাঝের দিকে হার্টের আকার দেয়া থাকে আর চোখদারে থাকে দুটি চোখ। দাবার ঘর আঁকা থাকে বলে ঘুড়ির নাম হয়ে যায় দাবাদার।

হাসমত একাই সব তৈরি করেন:

ঘুড়ি তৈরির জন্য খুব ভোরে ওঠেন হাসমত। কনকনে শীতে ঘুড়ি বানানোর জন্য বাঁশের কাঠি, ছুরি, আঠা ও কাঠের একটি পাটাতন নিয়ে নিজ কক্ষে ঘুড়ি বানাতে বসে পড়েন, মাঝে মাঝে ছাদেও ঘুড়ি তৈরি করেন। এই ঘুড়ি তৈরির মালামাল আনেন বিভিন্ন জায়গা থেকে।  

এ প্রসঙ্গে হাসমত বলেন, "ঘুড়ির জন্য উন্নতমানের টিস্যু কাগজ নিয়ে আসি নয়াবাজার থেকে। আর বাঁশ যেটা দিয়ে ঘুড়ি বাঁকানো হয় সেটি আনা হয় কেরানীগঞ্জ থেকে।" 

একটি ঘুড়ি বানাতে চার ধরনের কাজ করতে হয়। বাশঁ কেটে চিকন ও লম্বা কাইম তৈরি করা, টিস্যু কাগজ কেটে নকশা করা, রঙ করা ও আঠা দিয়ে জোরা দেয়া। এই কাজগুলো তিনি একাই করেন। এজন্য চাহিদা থাকলেও যোগান দিতে পারেন না।

"আমার কোনো শিষ্য নেই। তাই চারজনের কাজ নিজেকেই করতে হয়। কাজেই আগে যেমন পাঁচশোর মতো কাইম কাটতে পারতাম, এখন তা হয় দুইশোর মতো। তাই ঘুড়িও হয় দুইশোটা। চাহিদা আছে, কিন্তু দিতে পারি না," বলেন এই ঘুড়ি কারিগর।

হাসমতের পরে কে হবেন এই ঘুড়ির কারিগর?

এক সময় ঘুড়ি তৈরি করা পুরান ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পেশার একটি ছিল। এখন কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজেদের কারখানায় ঘুড়ি তৈরি করেন, আবার কিছু আসে ভারত থেকে। এদিকে হাসমতের নেই কোনো কারখানা৷ তাহলে কে ধরবেন তার এই শখের হাল? তার সন্তান কি হাসমত ঘুড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখবেন? 

হাসমত বলেন, "আমার সন্তান ঘুড়ি বানাবে না। সত্যি কথা বলতে এই কাজের ভবিষ্যত নেই। অনেক স্বপ্নই ছিল, কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।" 

পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন শীতে পুরান ঢাকার আকাশ হাজার-হাজার ঘুড়িতে ছেয়ে যায়। এই আকাশে ওড়ে ফারদিনের পছন্দের হাসমতের ঘুড়ি যে ঘুড়িতে লেগে আছে শৈশবের স্মৃতির স্নিগ্ধ গন্ধ।

নিজের বানানো চোখদার ঘুড়ির দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন হাসমত। মৃদুস্বরে বললেন, "আমার শখ আর ভালোবাসা থেকেই ঘুড়ি বানাই। যতদিন বেঁচে আছি ঘুড়িই বানাবো। কিন্তু আমাকে দিয়ে শেষ হবে এই হাসমত ঘুড়ি, আমার পরে কেউ করবে না।" 

 

মোঃ ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত। 

mohd.imranasifkhan@gmail.com

 

Share if you like