আজ থেকে একশ বছর আগেকার কথা। চলচ্চিত্র তখনো ভাষা পায়নি। নির্বাক চলচ্চিত্র হিসেবে ১৯২২ সালে ড্যানিশ চিত্র পরিচালক বেনজামিন ক্রিস্টেনসেন এর পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছিল 'হাক্সান।' এটি ছিলো একটি সুইডিশ প্রোডাকশন কোম্পানি স্ভেন্সক ফিল্মিন্ডাস্ট্রি প্রযোজিত চলচ্চিত্র। সে বছরই জার্মানিতে এফ.ডব্লিউ মরনু বানিয়েছিলেন নসফেরাতু। সেটি ছিলো জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট ধারার চলচ্চিত্র। বেনজামিন এক্ষেত্রে আনেন অভিনব এক ধাঁচ। তিনি সিনেমাটি বানান কয়েকটি অধ্যায় বা চ্যাপ্টারে ভাগ করে, ডকুমেন্টরি স্টাইলে। যেন দর্শকের মনে হবে তারা কোনো বইকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখছে পর্দায়। সে সময় সংলাপগুলো দৃশ্যের পর পর্দায় ভাসতো। ভৌতিক পরিবেশ, শাণিত ও যথাযথ দৃশ্য নির্মাণের মাধ্যমে অনবদ্য এক নিরীক্ষা করে ফেলেন বেনজামিন।
অকাল্টবিদ্যার পশ্চিমা পরিক্রমা নিয়ে সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করে তিনি এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিশ্বাস ও চর্চা তুলে ধরেন। এই সাতটি চ্যাপ্টারে অনেক বড় পরিসরে ব্যাপারগুলো তুলে আনেন তিনি। বিশেষত মধ্যযুগে ইউরোপে চলা ডাকিনীবিদ্যার চর্চা ও এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন নারীদের প্রাণদণ্ডের ব্যাপারটি ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠে৷
বেনজামিন ক্রিস্টেনসেন নিজেই এ ব্যাপারে বলেছিলেন, 'আমার এই ছবিতে গল্পের কোনো ধারাবাহিকতা নেই, কোনো প্লট নেই।
এটাকে বরং বলা যায় ছবির মাধ্যমে চলতে থাকা সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিষয়ক লেকচার।"
সিনেমাটিতে ছিলো স্থিরচিত্রের ব্যবহার। ছবি: নেক্রোম্যান্টিক.কম
চতুর্দশ শতাব্দীতে জার্মান ডাকিনী-শিকারীদের নিয়ে হেইনরিখ ক্রেমারের লেখা 'ম্যালিয়াস মেলফিক্যারাম' বইটির সৃজনশীল ও আধুনিক চিত্ররূপ বলা যায় হাক্সানকে। ওই বইটিতে বিভিন্ন রকম শয়তানি কার্যকলাপের ধারণা, বিবরণ ও সেসব মোকাবেলার উপায় আলোচনা করা হয়।
সিনেমাটির প্রথম অধ্যায়ে আমরা দেখি, ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয়ে সোজাসাপ্টা বয়ান ও প্রাসঙ্গিক দৃশ্য। দ্বিতীয় অধ্যায়ের চিত্রায়নে আমরা দেখি ডাকিনীবিদ্যার মূল কিছু বিষয়ের সংক্ষিপ্ত ও উপভোগ্য চিত্রায়ন।
এরপরের অধ্যায়গুলোতে সিনেমার কাহিনী খুবই নাটকীয় হয়ে উঠতে থাকে। অস্বস্তিকর এক ন্যারেটিভের অবতারণা করেন ক্রিস্টেনসেন। মারিয়া (এমি স্কোনফেল্ড) নামের একটি মেয়েকে ডাকিনীবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে নির্যাতন করা হয়। তার কাছ থেকে আদায় করা হয় বহুরকম অকাল্ট (অতিন্দ্রীয়) ধরনের কাজে যুক্ত থাকার স্বীকারোক্তি। যার ভেতর ছিলো শয়তানের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করার স্বীকারোক্তিও! তারপর তাকে স্টেকে গেঁথে অন্য ডাইনীদের মতোই নির্মম পরিণতি দেয়া হয়।
ছবিটি নির্মিত হয়েছিল ডকুমেন্টরি ধাঁচে। ছবি: নেক্রোম্যান্টিক
এমন নৃশংস দৃশ্যের পসরার পর শেষ দিকের চ্যাপ্টারগুলোর মূল লক্ষ্য ছিলো এই ডাইনি বানানোর প্রবণতার আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। এমন সম্ভাবনা থাকে যে, ডাইনী বলে অভিযুক্ত বেশিরভাগ নারীরাই মূলত চাপের মুখে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।
হরর সিনেমায় ভৌতিক প্রকাশটি দুভাবে ঘটে- ভিসেরাল ও সাইকোলজিকাল। ভিসেরাল বা বডি হররের প্রকাশ মূলত শারীরিক আঘাত বা এমন কাজের মাধ্যমে ঘটে।
আর সাইকোলজিকাল হরর ছাপ ফেলে মনে। হিচককের 'সাইকো'(১৯৬০) সিনেমার স্নানরত তরুণীকে হত্যার সেই দৃশ্য কে ভুলতে পারে? সেখানে আমরা ভিসেরাল ও সাইকোলজিকাল- দু ধরণের হররেরই দেখা পাই।
হাক্সানও তেমনি শুধু কিছু দৃশ্যের সমন্বয়ে তৈরি ডকুমেন্টরি ছিলো না। শুরুর দিকের তত্ত্বীয় ব্যাপারগুলো বাদ দিলে, সিনেমাটি জুড়ে আছে মেরুদণ্ড কাঁপানো শীতল শিহরণ। অকাল্ট চর্চার বিবরণ ও দুঃসাহসী দৃশ্যায়ন সিনেমাটির অনেক জায়গায়ই দর্শককে কাঁপিয়ে তুলতে পারে। যেমন- শয়তানের চারপাশে উন্মত্ত হয়ে নৃত্যরত লোকেরা যখন তার প্রতিনিধি অপদেবতার উদ্দেশ্যে শিশু উৎসর্গ (বলিদান) করে।
'ফোক হরর রিভাইভাল প্রোজেক্ট' এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্ডি প্যাসিওরেক এর মতে, "সিনেমাটি একইসাথে সুন্দর ও বীভৎস - দুইয়ের মধ্যে চমৎকার ভারসাম্য রেখেছে। কিছু দৃশ্য এমন রয়েছে যেগুলো সত্যিই খুব অদ্ভুত!"
বিবিসির কুখ্যাত ভৌতিক সিরিজ 'গোস্টওয়াচ' (১৯৯২) এর চিত্রনাট্যকার স্টিফেন ভল্ক এর মতে, " এটি অভিজ্ঞতা দেয় ভিসেরাল হররের, কিন্তু একে দেখা হয়েছে শুধু জ্ঞানগর্ভ গবেষণা হিসেবে!"
১৯২৪ সালে সিনেমাটির পরিচালক বেনজামিন ক্রিস্টেনসেন, ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
তার মতে, " একমুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি দর্শকে চমকে দেয়ার বাইরে সত্যিকার অর্থে পরিচালকের অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিলো, নয়তো তার উদ্দেশ্য ছিলো দর্শককে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দেয়া, যা ভালো হরর ছবিগুলো করে থাকে। বিভিন্ন সিনেমাকে অতীতে বলা হয়েছে 'অভিশপ্ত'- সেসবে নাকি আছে শয়তানের সংস্পর্শ ; কিন্তু এই সিনেমায় সত্যি সত্যি আপনি সেটা বিশ্বাসও করে ফেলতে পারেন! এর ফরম্যাটটাই এমন যে, আপনাকে বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে! সিনেমাটির কৌশল, হলদেটে ছবি ও নন্দনতত্ত্ব (হরর হিসেবে) আপনাকে খুব সহজেই এমন বোধ করাবে যে, আপনি মধ্যযুগের সেই সময়টাতেই ফিরে গেছেন ও ঘটনাগুলো দেখছেন!"
এই হাড় হিম করা দৃশ্যগুলো তৈরির জন্য প্রচুর কলাকৌশল, যেমন- গা ছমছমে ইফেক্টের ব্যবহার, স্থিরচিত্র, অবিশ্বাস্য রকমের অভিনব মেক-আপ, এমনকি ক্যারোসেল ব্যবহার করে ডাইনিদের ঝাঁটায় বসে উড়ে বেড়ানোর দৃশ্যও তৈরি করা হয়েছিলো।
পরিচালক ক্রিস্টেনসেন নিজেই অভিনয় করেছিলেন শয়তানের ভূমিকায়। সিনেমায় প্রাচীনকালের ধর্মীয় অবমাননার শাস্তি ও ডাকিনীবিদ্যার বিস্তারিত বিবরণ দর্শককে সেখানেই উপস্থিত করায়! ক্রিস্টেনসেন নিজে যেন হয়ে ওঠেন সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিরূপ- যে আড়াল থেকে সবটা দেখে হাসছে!
সিনেমাটি মুক্তির সময়ে এ নিয়ে কিন্তু বিতর্কও কম হয়নি। 'ভ্যারাইটি' ম্যাগাজিনে ১৯২৩ এ প্রকাশিত এক সমালোচনায় উল্লেখ করা হয়, 'ছবিটি যদিও খুবই অসাধারণ, কিন্তু জনসম্মুখে প্রদর্শনের উপযোগী নয়।"
ক্রিস্টেনসেনের এই সিনেমা মুক্তির পর এমনিতেও বিবেচিত হতে থাকে গোপনীয় ও দুর্ভাগ্যসূচক এক কাজ হিসেবে। ইউরোপ থেকে আমেরিকা- যেখানেই এটি মুক্তি পেয়েছে, সেখানেই একে প্রচুর কাট-ছাঁট করা হয়েছে; বিশেষত এতে থাকা নৃশংসতা ও নির্যাতনের দৃশ্য ও সার্বিকভাবে ব্লাসফেমাস বোধ হওয়ার মতো জায়গাগুলো। যেমন- ক্রুশ ভেঙে ফেলা কিংবা শয়তানের পশ্চাতদ্দেশে ডাইনীদের চুম্বনের দৃশ্যগুলো অবমাননাকর বিবেচিত হয়েছিলো। সে সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সুইডিশ প্রযোজনা হলেও একে খোদ সুইডেনেই সেন্সরের কাঁচি ফালাফালা করে ফেলেছিলো।
সিনেমাটির প্রযোজকরা কপিরাইট নবায়ন না করায় এটি শেষমেশ পাবলিক ডোমেইনেরই অংশ হয়ে যায়। ছেঁটে ফেলা বিভিন্ন অংশ এর ভেতর উদ্ধারও করা হয়। ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশ চিত্র পরিচালক অ্যান্থনি বাল্ক, জ্যাজ সঙ্গীতকার ডেনিয়েল হুমাইর (আবহসঙ্গীত) ও লেখক উইলিয়াম বুরোগস এর সাহায্য নিয়ে চলচ্চিত্রটি পুনরায় সম্পাদনা করেন। ষাটের দশকের শেষদিকে আমেরিকায় মেট্রো পিকচারস কর্পোরেশনের উদ্যোগে এটি ' রিমিক্স ফিল্ম' হিসেবে মুক্তি পায়। পরিচিতি পায় 'অকাল্ট এক্সপ্লয়টেশন সিনেমা' হিসেবে। সে সময়ে এটি দর্শকপ্রিয়তাও পায়।
ক্রিস্টেনসেনের এই সিনেমাটি সে সময়ের হরর সিনেমা যেমন- ফ্যান্টম ক্যারিজ বা গোলেম থেকে আলাদা। এখানে তত্ত্বীয় কাঠামোর সাথে দৃশ্যায়নে যে ফ্যান্টাসি তিনি তৈরি করেন তা অভিনব ও অকৃত্রিম বোধ হয়। শুধু ভিসেরাল হরর নয়, এর শেষ দুই চ্যাপ্টারে তিনি অদ্ভুতুড়ে ঘটনাগুলোর বিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। ফলে 'সাইকোলজিকাল প্যাথোস' এর জায়গা থেকেও সিনেমাটি গুরুত্বপূর্ণ।
হাক্সানের চূড়ান্ত অধ্যায়টি (সপ্তম) মূলত এমন ভাবনার ওপর ভিত্তি করে- অতীন্দ্রিয় আচরণগুলোর পেছনে আছে মানসিক বিকারগ্রস্থতা। আর এক্ষেত্রে অনেকে নিজেদের একপেশে চিন্তা ও অজ্ঞতার ফলে সেটিকে অনেকক্ষেত্রে শয়তানসম্বন্ধীয় আচরণ মনে করেছে। এর পাশাপাশি, ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত নিরপরাধ মেয়েগুলোকে কীভাবে অস্ত্র ও পেশিশক্তির সাহায্যে অভিযুক্ত করে স্বীকারোক্তি আদায় করছে তা তিনি দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনোরকম অপরাধ প্রমাণ হওয়া ছাড়াই অভিযুক্তকে শাস্তি দেয়া ও তার পক্ষে সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়ার কারণ অনুসন্ধানও করেছেন তিনি। :
'ক্যাবিনেট অভ ডা. ক্যালিগারি' (১৯২০), নসফেরাতু (১৯২২) ও 'দ্য হ্যান্ডস অভ ওরলাক' সিনেমাগুলোতেও মানুষের মনের গহীনে লুকোনো অন্ধকারকে বের করে এনেছিলো। তবে হাক্সান এখানে শুধু অন্ধকারকে চিহ্নিত ও চিত্রায়িত করেনি, বরং এটি রেখেছে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতার ছাপ। প্রশ্ন করেছে মধ্যযুগীয় পুরোহিততন্ত্র ও ক্ষমতাকাঠামোকে।
এই সিনেমাটি থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট (১৯৯৯) বানিয়েছিলেন এদুয়ার্দো সানচেজ ও ডেনিয়েল মাইরিক। তাদের প্রোডাকশন হাউসের নামও 'হাক্সান ফিল্মস।'
সেই সিনেমায় সত্যিকার ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছিল। কৌশলটি হাক্সান থেকেই তারা নেন। তবে হাক্সান সিনেমাটিতে সত্যিকার ফুটেজ না নিয়েও অভিনয়ের মাধ্যমেই মধ্যযুগীয় আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো সুনিপুণভাবে। স্থিরচিত্র যা ছিলো, সেগুলোও পরিকল্পিত ফটোগ্রাফি। পরবর্তীতে এই ধাঁচের সিনেমা নির্মাণ হয়েছে বেশ কিছু, তবে এর মতো সাইকোলজিকাল প্যাথোস অন্য সিনেমাগুলো ধারণ করতে পারেনি।
মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলবে এমন বেশকিছু হরর দৃশ্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও, এর মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা একে সিনেমা হিসেবে স্থায়িত্ব দিয়েছে। সাথে এর বইয়ের মতো কাঠামো, অধ্যায়ে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন সময়কে দেখা- একে অভিনব এক সিনেমায় পরিণত করেছে। বেনজামিন ক্রিস্টেনসন এক্ষেত্রে শয়তান ও অপদেবতাদের অস্তিত্বকে একেবারে নাকচ করেননি; মানুষের ব্যথা-বেদনা ও দুর্দশাকেও তেমনি দক্ষতার সাথে চিহ্নিত করেছেন। এই ফলে বিস্ময়কর এক মানবিক রূপও পেয়েছে এই সিনেমাটি৷ মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এমন প্রশ্নের সামনে, শেষপর্যন্ত মানুষের জন্য কে বেশি ভয়ংকর- শয়তান অপদেবতা নাকি ক্ষমতালোভী- স্বার্থান্বেষী অন্য মানুষেরাই?
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।