হাওরের বাঁধ সংস্কার: ‘নিয়মরক্ষার’ কাজ শুরু, আশঙ্কায় কৃষক


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: December 16, 2022 18:49:00 | Updated: December 17, 2022 17:11:42


হাওরের বাঁধ সংস্কার: ‘নিয়মরক্ষার’ কাজ শুরু, আশঙ্কায় কৃষক

গত বছর সুনামগঞ্জ জেলার হাওরে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ৭২৭টি প্রকল্পে কাজ হয়েছিল। চলতি বছরেও সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার বাঁধে সংস্কার কাজ হবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে প্রকল্প শুরুর নির্ধারিত দিন ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র শতকরা তিন ভাগের কাজ শুরু হয়েছে; যাকে ‘নিয়মরক্ষা’ বলছেন কৃষকরা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় হাওরের একমাত্র বোরো ফসল নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকলই বলে জানালেন তারা।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রি-ওয়ার্ক (সম্ভাবতা যাচাই) শেষ করে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন, ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা।

কিন্তু জেলার ১২ উপজেলায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মাত্র ১৯৩টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে। এদিন মাত্র ২০টি প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। চলতি মাসে বাঁধের প্রকল্প গ্রহণ ও প্রাক্ষলন শেষ করে সব প্রকল্পে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন হাওর আন্দোলনের নেতারা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী-১ মো. মামুন হাওলাদার বলেন, “হাওরে পানি থাকার কারণে প্রি-ওয়ার্ক ও এস্টেমেট (প্রাক্কলন) করতে বিলম্ব হয়। এ কারণে যাছাই-বাছাই করে প্রকল্প গ্রহণ শেষ করে কাজ শুরু করতে দেরি হয়। তাছাড়া যে যন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে বাঁধে ফেলা হয় সেই যন্ত্রও হাওরের মাটি ভেজা থাকায় নামানো যায় না। যে কারণে বিলম্ব হয়।”

এবারও এই কারণে দেরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই মাসের শেষ দিকে কমিটির সভা আছে। আশা করা যাচ্ছে, এই মাসেই বেশিরভাগ প্রকল্প অনুমোদন পাবে এবং কাজ শুরু করা যাবে।”

পাউবো ও হাওর আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় ছোট-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। এই হাওরের বেড়িবাঁধের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭১৮ কিলোমিটার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছিল।

চলতি মৌসুমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পাউবো প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। গত অক্টোবর মাস থেকে তাদের ২৭টি দল (সার্ভেয়ার ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী) হাওরে গিয়ে সম্ভাবতা যাচাই করেছে। এখনও প্রাক্কালনের কাজ চলছে।

কৃষকরা জানান, এক সময় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হতো। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কৃষক আন্দোলনে নামে। সরকার ২০১৭ সালে বিশেষ কাবিটা আইন করে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ কৃষকদের নেতৃত্বে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি-পিআইসি।

উপজেলার বাঁধ ব্যাবস্থাপনা কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সভাপতি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সদস্যসচিব হিসেবে রয়েছেন। তারা প্রকল্প তৈরি করে জেলা বাঁধ ব্যাবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্যসচিব পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠাবেন। নীতিমালা অনুসারে, হাওর এলাকায় প্রকাশ্যে গণশুনানি করে কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে বাঁধ এলাকার কৃষকদের নেতৃত্বে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

গণশুনানি করে প্রতিটি প্রকল্পে বাঁধের নিকটবর্তী জমির মালিক বা তিনজন কৃষক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট একজন সদস্য, সংশ্লিষ্ট এলাকার হাইস্কুল বা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি গঠন করা হয়। তবে এই কমিটি গঠন ও গণশুনানি নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে কৃষকদের।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, “এবারও নামকাওয়াস্তে মাত্র কয়েকটি প্রকল্পের লোকদেখানো উদ্বোধন হয়েছে।”

এই মাসেও সিকিভাগ প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন করে কাজ শুরু করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক কারণেও পিআইসি গঠন ও কাজ শুরুতে বিলম্ব হয়।”

এ ব্যাপারে শাল্লা উপজেলা হাওর রক্ষা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও ইউএনও মো. আবু তালেব বলেন, “আমরা নির্ধারিত দিনে ১১টি প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পেরেছি। গণশুনানি করে স্বচ্ছতার সঙ্গে পিআইসি গঠন করে আমরা কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে কাজ করছি।”

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও হাওরের বাঁধ ব্যবস্থাপনা জেলা কমিটির সভাপতি দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিটি উপজেলায় কাজ শুরু করতে পেরেছি। মাঠে প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতার কারণে প্রকল্প গ্রহণ ও প্রাক্কলনে বিলম্ব হয়। তবে নীতিমালার আলোকে যাতে কাজ করা হয় সেজন্য উপজেলা কমিটিগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই।”

পাউবো প্রতি বছরই কাজ শুরু করতে দেরি করে বলে অভিযোগ কৃষকদের। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাজ দেরি করে শুরু করার প্রভাব বেড়িবাঁধে ও ফসলের ওপর পড়ে।

জগন্নাথপুর উপজেলার খাগাউড়া গ্রামের কৃষক জয়নাল আবেদিন বলেন, “আমাদের নলুয়ার হাওর একটি ঝুঁকিপূর্ণ হাওর। এখনও কাজ শুরুর নাম নাই। প্রতি বছর শেষ দিকে এসে কাজ শুরু করে। তখন কাঁচা বাঁধ বন্যার ঝুঁকিতে থাকে। আগে কাজ শুরু হলে বাঁধের কাজ টেকসই হয়।”

তাহিরপুর উপজেলার জয়পুর গ্রামের কৃষক খসরু মিয়া বলেন, “আমাদের শনির হাওরের ফসল সবসময় ঝুঁকিতে থাকে। আমরা সবসময় দাবি জানিয়ে আসছি, ডিসেম্বরে কাজ শুরু করে ফেব্রুয়ারি শেষ করার কথা। কিন্তু এখনও কাজ শুরুর নাম নাই।”

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছিল, প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্প গ্রহণ করে ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা। কিন্তু কোনো সময়ই যথাসময়ে যথাযথভাবে কাজ হয় না। এবারও তাই হয়েছে।

“বিলম্বে কাজ শুরুর ফলে মাটির বাঁধে মাটি বসে না। বৃষ্টি এলে ফাঁক-ফোকর দিয়ে ফাটল দেখা দেয় এবং জলের টানে বাঁধ ভেঙে যায়। তবে প্রাক্কলন, প্রকল্প অনুমোদনে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও কাজ শুরু ও শেষ করতে বিলম্ব হয়।”

Share if you like