গ্রীক মিথলজির সেই সর্পকেশী দানবীর কথা মনে আছে? মেডুসা-দেবতাদের অভিশাপে যিনি অপরূপ সুন্দরী থেকে সর্পকেশী দানবে পরিণত হয়েছিলেন। তার চোখের দিকে কেউ তাকালেই সে পাথরে পরিণত হয়। এতো গেলো পৌরাণিক যুগের এক গল্পগাঁথা। তবে বাস্তবে এমন একটি রোগ রয়েছে যার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে পাথরে পরিণত হয়।
ঘাড়, বুক ও তলপেটে খানিকটা ফুলে গিয়ে শক্ত হয়ে গেছে এবং এই জটিলতার কারণে গত ২ বছর যাবত একদম চলাফেরা করতে পারে না- ৮ বছর বয়সী একটি ছেলে শিশুকে এমন সব সমস্যার কারণে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসা হয়। এই শিশুটির জন্ম থেকেই পায়ের গোড়ালির গঠনগত কিছু সমস্যা ছিল।
পরীক্ষা নিরিক্ষার পালা শেষে জানা যায়, শিশুটির দেহের যে সফট টিস্যুগুলো রয়েছে তা শক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং কোথাও কোথাও তা আকৃতিতে বেড়ে যাচ্ছে।
এটি একটি বিরল ধরনের রোগ যা ফিব্রোডিসপ্ল্যাসিয়া অসিফিক্যানস প্রোগ্রেসিভা বা স্টোনম্যান সিনড্রোম হিসেবে পরিচিত। এটি একটি জেনেটিক ডিজঅর্ডার। এর ফলে হাত ও পায়ের একটোপিক সফট টিস্যুগুলো আক্রান্ত হয় এবং দেহের কানেকটিভ টিস্যু, মাসল টিস্যু, লিগামেন্ট ও টেনডনসগুলো ধীরে ধীরে হাড়ে পরিণত হতে শুরু করে।
একসময় শরীরের যে কাঠামো বা কংকাল রয়েছে তার বাইরে দিয়ে হাড়ের পুরু আস্তর জমা হয় ফলে মানুষ একদম চলাফেরা করতে পারে না এমনকি খাওয়াদাওয়া বা কথা বলাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠে যখন বুকের পাঁজরের চারপাশে বাড়তি হাড় জমে ফুসফুসের জায়গা সংকুচিত হয়ে যায়। এই কারণে একজন আক্রান্ত রোগীর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
প্রতি ২০ লক্ষ জনে একজন আক্রান্ত হয় এই পাথুরে রোগে। সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে স্টোনম্যান সিনড্রোম বেশি দেখা যায়। জন্মের পর থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এর শুরুটা হয় ঘাড় বা কাঁধ থেকে এবং ধীরে ধীরে তা শরীরের নীচের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। তবে শরীরের যেকোনো অংশ, যেমন-পাঁজর, শ্রোণিদেশ, মাথার খুলি, ফিমার বা হিউমেরাস যেকোনো জায়গাতেই এই সিনড্রোম দেখা দিতে পারে। এই রোগটি যতটা না অদ্ভুত তারচেয়েও বেশি ভয়াবহ!
এই রোগের কারণে পাশাপাশি আরো যে জটিলতাগুলো সৃষ্টি হয়-
আর্থ্রাইটিস, হাড় ভেঙে যাওয়া, হাড়ের অনিয়মিত গঠন, খাওয়া ও কথা বলার জটিলতা, শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়া, দৃষ্টি শক্তি লোপ পাওয়া, শ্বাসকষ্ট, চলাফেরার সমস্যাসহ সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথার সৃষ্টি হয়।
কেন হয়?
- হাড়ের কোনো বিশেষ প্রোটিনে কেমিক্যালগত ত্রুটি থাকলে।
- ভূমিষ্ট হওয়া থেকেই কারো শরীরে জিন মিউটেশন ঘটে থাকলে।
- হাড়ের কোনো অংশে অনিয়মিত ও অস্বাভাবিক বোন টিস্যুর উপস্থিতি থাকলে।
লক্ষণ
লক্ষণ সম্পর্কে জানা থাকলে রোগ দ্রুত চিহ্নিত ও সে অনুযায়ী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া সহজ হয়।
- হাড়ের অনিয়মিত গঠন।
- ভঙ্গুরতা প্রবণ হাড়।
- হাড়ের অসামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধি।
- জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা।
- মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়া।
- সোজাভাবে হাঁটতে না পারা।
- হাড়ে ব্যথা।
এই রোগ কি সেরে যায়?
দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই রোগের প্রতিকার বা বৃদ্ধি রোধে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থার আবিষ্কার হয়নি। তবে রোগীর শারীরিক জটিলতা বা কষ্ট কিছুটা লাঘবের জন্য রোগীভেদে অনেকসময় কিছু ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়।
শবনম জাবীন চৌধুরী বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকে অধ্যয়নরত।