'মালটাকে গাড়িতে তোল'- নবাব (১৯৯১) সিনেমার এই সংলাপটি সম্প্রতি আবারো আলোচনায় এসেছে একটি মিমের কল্যাণে। মিম টি প্রথম কে বানিয়েছিলেন তা নিশ্চিত জানা যায়নি। তবে সেই মিমটি ছিল বাকস্বাধীনতা সম্বন্ধে। এরপর 'মালটাকে হাঁড়িতে তোল' (অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী ও মিশনারি সম্পর্কে), 'মালটাকে কোলে তোল (রাস্তায় দেখা কুকুর-বিড়াল বিষয়ে), 'মালটাকে গণরুমে তোল' (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুম কালচার বিষয়ে), 'মালটাকে চিপায় তোল' (মোহাম্মদপুরে আইফোন নিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া) ইত্যাদি ভার্সন তৈরি হয়েছে এই মিমের।
তার সাথে সাথে আবারো প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় সৌমিত্র ব্যানার্জী, যাকে সিনেমায় এই সংলাপটি বলতে দেখা গিয়েছিল। সৌমিত্র ব্যানার্জী আশি ও নব্বই দশকে বেশ কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে খলচরিত্রে অভিনয় করে দর্শক হৃদয় জিতে নেন। রঞ্জিত মল্লিক, তাপস পাল, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত - সবার সাথেই উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। তবে রঞ্জিত মল্লিকের সাথে তার নায়ক-খলনায়ক দ্বৈরথ ছিল দেখার মত।
সৌমিত্রের জন্ম ১৯৫৪ সালে। হুগলির পান্ডুয়ার জমিদার পরিবারের সন্তান। ১৯৬৪ তে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিষিক্ত হলেও ১৯৮২-তে 'ত্রয়ী' সিনেমায় নায়ক হয়ে নিয়মিত কাজ শুরু।
তবে অচিরেই তিনি চলে আসেন খলচরিত্রে। ১৯৮৫/৮৬ সালের পর থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত নিয়মিত কাজ করেছেন। এরপর ১৯৯৮ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে।
আশির দশকে 'গুরুদক্ষিণা' (১৯৮৭) কিংবা 'আশীর্বাদ’ (১৯৮৬) সিনেমায় অভিনয় করে আলোচিত হন।
গুরুদক্ষিণা' সিনেমায় টাকা চুরি করে তাপস পালকে ফাঁসানোর জায়গাগুলোয় সৌমিত্র দারুণ ছিলেন। তবে তার অভিনয়ের ধরন ছিল ক্যাজুয়াল। এক্সপ্রেশনে কিছু বিষয় ঘুরে ফিরে আসত। সংলাপ বলার সময় কী বলতে যাচ্ছেন তা কখনো কখনো আগেই বুঝে নেয়া যেত।
অবশ্য তার চোখের অভিব্যক্তি ও আকর্ষণীয় সংলাপ তাকে সে সময়ের জনপ্রিয়তম খলনায়কে পরিণত করে। যেমন- 'রাগলে তোমায় দারুণ লাগে' সংলাপটিও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
সৌমিত্রকে নিয়ে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, তিনি ভানু বন্দ্যেপাধ্যায়ের পুত্র! কথাটি একেবারেই সত্যি নয়। অনেকে তবুও তা বিশ্বাস করতেন। লোকে বলত, এত ভালো কমেডি অভিনয় বাপের, আর তার ছেলে হয়ে কিনা এসব অভিনয়!
যদিও এই দুই ব্যানার্জী পিতা-পুত্র নন, তবে এসব কথা প্রমাণ করে সৌমিত্র খলনায়ক হিসেবে কতটা জনপ্রিয় হয়েছিলেন!
মদ্যপানের অভ্যাস ছিল তার। আর ঘুমের অনিয়মের কারণে চোখের নিচে জমেছিল কালি। এই ব্যাপারটি তার ভিলেন হিসেবে পর্দা উপস্থিতিকে আরো তীক্ষ্ণ করেছিল।
বিভিন্ন চলচ্চিত্রেই তার এমন আকর্ষক সংলাপ/দৃশ্য আছে। যেমন- 'আগমন' (১৯৮৮) সিনেমায় দেবশ্রী রায় যখন তাকে বলছেন 'আমি কোন পুতুল নই, আমি একজন মানুষ', সৌমিত্র তার সেই কূট হাসি হেসে বলেন, 'বাহ! রাগের পাশাপাশি আপনার কান্নাও দেখছি ভারি সুন্দর! এমন কিছু কি মিস করা যায়?'
এভাবে তীক্ষ্ণ সংলাপগুলো দিয়ে সৌমিত্র মোমেন্টাম ঘুরিয়ে নিতেন নিজের দিকে। এসময় আরো কিছু চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন।
'অমর প্রেম' (১৯৮৯) কিংবা 'অমর সঙ্গী' (১৯৮৭) সিনেমায় প্রসেনজিতের সাথে তার নায়ক-খলনায়ক রিদম জমে ওঠে। 'অমর সঙ্গী' তে নায়িকাকে অপহরণের দৃশ্য কিংবা 'অমর প্রেম' সিনেমায় স্ত্রীকে হত্যার দৃশ্যগুলো স্মৃতিতে গেঁথে থাকার মত।
'অমর প্রেম' সিনেমার সেই দৃশ্যে একটি হোটেল রুমে যখন মেয়েটি বলছে তাদের বিয়ের কথা, তার কত স্বপ্ন সংসার নিয়ে; তখন পরকীয়ালিপ্ত সৌমিত্র বিচলিত-ক্ষুব্ধ৷ কথাগুলো বলে চলছে মেয়েটি, আর তার চেহারা কঠিন হচ্ছে। আপেল কাটার চেষ্টা করছিল সে ছুরি দিয়ে। তারপর তার মুখ আরো কঠোর হয়, ধূর্ততায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ছুরিটি নিয়ে সে ধীরে ধীরে এগোয়, তারপর স্ত্রীর শরীরে গেঁথে দেয়।
সৌমিত্র এ সময় আরো কিছু সিনেমায় অভিনয় করেন। তবে ১৯৯২ এর পর মদে আসক্তি, ব্যক্তিগত হতাশা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ব্যক্তিজীবনে গুণী অভিনেত্রী রিতা কয়রালের সাথে সম্পর্কের ও বিয়ের গুঞ্জন ছিল। তবে পরে অন্যত্র বিয়ে করেন।
জীবনযোদ্ধা (১৯৯৫) সিনেমায় ব্যবসার কাজে স্ত্রীকে পণ্যের মত ব্যবহার করতে চাওয়া, স্ত্রীর আপত্তি শুনে প্রচণ্ড কুটিল সেই অট্টহাসি, তারপর কঠিন চোখে চাবুক হাতে নেয়ার দৃশ্যে ভয়ঙ্কর সৌমিত্র। তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি 'ইন্দ্রজিত'(১৯৯৩) -এ পুলিশ অফিসার রঞ্জিত মল্লিকের চোয়ালের নিচে পিস্তল ঠেকিয়ে 'এই শালাকে আমি লকাপে পুরে চাবিটা বাড়ি নিয়ে যাবো' বলাতেও ছিল ড্যাম-কেয়ার ভাব।
নব্বই দশকে ক্রমান্বয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়লেও ১৯৯৬ এ চিরঞ্জিত পরিচালিত 'ভয়' সিনেমাতে সৌমিত্র তার অভিনয়জীবনের সেরা কাজটি করেন। স্ত্রী জয়া অর্থাৎ, দেবশ্রী রায়কে পিশাচের মত নানারকম শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করেন। গরম ডাল গায়ে ঢেলে দেয়া, পরিষ্কার সিঁড়িতে জুতো নিয়ে ওঠা- এসব তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। পরে স্ত্রীকে ব্যবসার প্রয়োজনে পার্টনারের রক্ষিতাতেও পরিণত করতে চান।
এরপর সে রাতেই স্ত্রী উধাও হলে প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে খুঁজতে শুরু করেন। এই সিনেমায় হাউন্ড নিয়ে দেবশ্রীকে খোঁজা, শঙ্কর চক্রবর্তী কিংবা চিত্রা সেনকে হত্যার দৃশ্যগুলো হাড় হিম করার মত।
অন্ধ চিত্রা সেনের কাছে যখন দেবশ্রীর খোঁজের জন্য যান, হাতে একটা ছুরি, নিজেকে পুলিশ হিসেবে পরিচয় দেয়া সৌমিত্রের চোখে রাজ্যের কুটিলতা। শাশুড়ির মুখে নিজের নাম শুনেও অতি আত্মবিশ্বাসে বলা 'সে আমি জানি'। তারপর মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঠিকানার খোঁজ, পরে অন্ধ শাশুড়িকে খুন করে ফেলা।
ছবির শেষদিকে আরেকটি জায়গায় যখন সৌমিত্রকে দুলাল লাহিড়ী ছুরি মারছেন তখন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার সৌমিত্রের অভিনয়, কিংবা ক্লাইম্যাক্স এ মৃত মনে হওয়া সৌমিত্রের আবারো চিরঞ্জিতকে হত্যার জন্য উঠে দাঁড়ানো- সবমিলিয়ে সৌমিত্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজটি করেন এই সিনেমাতেই৷
এরপর বিচ্ছিন্নভাবে হাতে গোনা কয়েকটি কাজ। সুযোগ ছিল প্রচুর। এই সিনেমা তাকে অন্যরকম ক্রেজ এনে দিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে অতিরিক্ত মদ্যপান কেড়ে নিয়েছে তার লিভারের কার্যকারিতা৷
১৯৯৮ এর পর থেকে সৌমিত্র অসুস্থই ছিলেন। এ সময় আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন। লিভারে সিরোসিস ধরে গিয়েছিল।
২০০০ সালের ৮ জানুয়ারি। শীতের এক সকালে কোলকাতায় এক নার্সিং হোমে মৃত্যু হয় তার। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপানো এই খলনায়কের প্রস্থানের পর এরপর ২২ বছর কেটে গেছে। ফর্সা গোলগাল চেহারার সৌমিত্র 'লাল্টু দা' নামে পরিচিত ছিলেন। হয়তো কেউই ভাবেননি, এতদিন পর একটি মিম আবার নানা রূপে, নানা বার্তায় এত জনপ্রিয় হবে! আর সেটি হবে তারই একটি সিনেমার সংলাপ দিয়ে!
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।