সৌন্দর্যের এক অনুপম সংজ্ঞা: মহারাণী গায়েত্রী দেবী


সুস্মিতা রায় | Published: December 29, 2022 16:34:39 | Updated: December 30, 2022 13:21:00


ছবি: মাসালা

মানুষের সৌন্দর্য শুধুই কি রূপের উপর বিচার্য নাকি তার ব্যক্তিত্ব ও কর্মের উপরও নির্ভরশীল, এই নিয়ে যুগ যুগ ধরে রয়ে গেছে নানা মুনির নানা মত। তবে 'বিউটি উইথ ব্রেন' অর্থাৎ সৌন্দর্যের সাথে ধারালো মস্তিষ্কই বোধ হয় অধিকতর মানুষের কাম্য। আর তারই যেন নিখুঁত প্রতিমা জয়পুরের মহারাণী গায়েত্রী দেবী।

রাজমাতা থেকে জননেত্রী, বিশ্বসুন্দরীদের সাথে এক আসনে ঠাঁই লাভ করেছেন যেমন, আবার তেমন কারার রুদ্ধদ্বারের পিছনে যাপন করছেন দিন - এমনই নানা বৈচিত্র্যের মিশেলে রঙিন ছিল এই কোচবিহারের রাজকুমারীর জীবন।

পারিবারিক সূত্রে গায়েত্রী দেবী ছিলেন তিন তিনটি জাতিসত্ত্বার উত্তরসূরি। পিতা কোচবিহারের রাজা জীতেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদূরের সূত্রে তিনি রাজবংশী আর মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন বরোদার মারাঠা রাজকুমারী। গায়েত্রীর ঠাকুমা সুনীতি দেবী প্রকৃত বঙ্গবালা, কেননা ছিলেন ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্রের কন্যা। তিনটি শক্তিশালী বংশধারা রক্তে নিয়ে গায়েত্রীর জন্ম হয়েছিল সুদূর বিলেতের লন্ডনে।

মায়ের দেয়া আদুরে নাম আয়েশা। আয়েশার শৈশবের পাঠ শুরু হয় বিশ্বভারতীর পাঠভবনে। পরবর্তীতে পরিবারের সাথে সুইজারল্যান্ডের লাসানে চলে যান আর সেখানেই পাঠ সমাপ্ত করেন।

আয়েশার দিদিমা চিমনাবাই দেবী খুবই তেজী মহিলা ছিলেন, যিনি কখনোই অন্দরে থেকে বদ্ধজীবন কাটাতে চাননি, পর্দা প্রথা শিকেয় তুলে পুরুষের জগতে পা ফেলেছিলেন। মা ইন্দিরা দেবীই কম যান কীসে, সেই যুগে রয়ে তিনি পারিবারিক বিয়ে মানতে ভীষণ নারাজ ছিলেন, আবদ্ধ হয়েছেন প্রেমের বিয়েতে। এমন এক পরিবারে জন্মে গায়েত্রী যে কেবল ভারী ভারী গহনা পরে পটের বিবিটি সেজে চুপটি করে বসে থাকবেন না, সেটাই তো স্বাভাবিক।

কলকাতায় পোলো খেলতে এসে জয়পুরের রাজা সওয়াই মান সিংয়ের কোচবিহার রাজপরিবারের সাথে পরিচয় হয়। তখন তরুণ রাজকুমারের চোখে ১২ বছরের চঞ্চলা আয়েশাকে বেশ মনে ধরে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন তিনি, এনাকেই বিয়ে করবেন। অবশেষে গায়েত্রী ২১ বছর বয়সে জয়পুরের তৃতীয় মহারাণী হয়ে পা ফেলেন রাজমহলে।

মহারাণী গায়েত্রী দেবী তার নিজস্ব ফ্যাশন কায়দায় ছিলেন অনন্যা। ভারী মেকআপ তার পছন্দ না, ছোট একটা টিপ আর গাঢ় শেডের লাল লিপস্টিকে সাজাতেন নিজেকে। সামান্য সাজেই তিনি আজীবন অপরূপা। চুলগুলি সবসময় ঘাড় অব্দি, এবং একদম পরিপাটি কখনোই তাদের স্থানচ্যুত হতে দেখা যায়নি। তিনি শিফনের শাড়ি পড়তে ভীষন ভালোবাসতেন যা আসত ফ্রান্সের লিওনের তাঁত হতে। 

শাড়িতে সোনালী সুতো, জরি আর মুক্তার কাজ পছন্দ করতেন। তার জামার বোতামগুলি থাকতো সব হাতে বানানো। রাজপরিবারের হয়েও হাবড়-জাবর তার একে বারে অপছন্দের ছিল। গহনা হিসেবে কেবলই শুধু পান্না বা মুক্তার হার। সাজের সব অনুষঙ্গে রঙের সামঞ্জস্য বজায় রাখতেন, নিজের আত্মকথার এক জায়গায় লিখেছেন- 'পান্না কখনোই সবুজ শাড়ির সাথে পরা উচিত নয়, বরং গোলাপি শাড়ির সাথে তা দেখতে ভালো মানায়।'

একবার বিখ্যাত 'ভোগ' ম্যাগাজিনের বিশ্বের সেরা দশ সুন্দরীর তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছিলেন। তাই এই আলাদা ধরনের স্টাইল নিয়ে জিগ্যেস করলে বলতেন," আমি মনে করি এসব আমার মধ্যে জন্মগত। আর এর বাইরে মা আমার রোল মডেল, তাকে দেখেই আমার সব বেশ-বাস।" কৈশোরে ভারতীয় ফ্যাশনের সাথে তার যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল সেটাই রয়ে গিয়েছিল আজীবন।

নিজের অনন্য বৈশিষ্ট্যর জন্য তিনি তো ষাটের দশকে ফ্যাশন আইকন ছিলেনই, কিন্তু আজও তাকে অনেকেই অনুসরণ করে থাকেন।

রানীর শখ ছিল পোলো খেলা আর নানান ব্র্যান্ডের গাড়ি সংগ্রহে। আধুনিক শিক্ষাধারায় মেয়েদের শিক্ষিত করতে তিনি জয়পুরে গায়েত্রী দেবী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

গায়েত্রী দেবী নিজেই তার আত্মজীবনী রচনা করেছিলেন - 'আ প্রিন্সেস রিমেম্বার্স' । মহারাণী রান্না করতেও ভালোবাসতেন। ভারতের নানা অঞ্চলের রাজকীয় রান্না সংগ্রহ করে 'গোওরমেয়'স গেটওয়ে' নামে বই প্রকাশ করেছিলেন।

ষাটের দশকে তার পদচারণা হয় রাজনীতির মঞ্চে। জীবনের প্রথম নির্বাচনে স্বতন্ত্রতা পার্টির হয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে রাজস্থানের আসনে বিপুল সংখ্যক ভোটে জয়ী হন। আশি শতাংশ ভোটই ছিল তার ঝুলিতে। এই অভাবনীয় জয়ের জন্য তিনি গিনেস বুকে আসন লাভ করেন। জন এফ কেনেডি মন্তব্য করেছিলেন- "সবচেয়ে বিস্ময়কর গরিষ্ঠতা, যা কোনো মহিলা কেবল একটি নির্বাচনে অর্জন করেছে।"

১৯৭০ সালে সওয়াই মান সিংহের মৃত্যুর পরে তিনি রাজমাতা পদে অভিষিক্ত হন। এরপরের বছর ইন্দিরা গান্ধীর জারিকৃত জরুরি অবস্থায় রানীর সকল রাজকীয় অধিকার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ৭৫' সালে কর ফাঁকির অভিযোগে রাজামাতাকে পাঁচ মাস তিহার কারাগারে কাটাতে হয়েছিল। এই সময় গুরুতর ভাবে গ্যাস্ট্রিক আলসারে অসুস্থ হয়ে যান, তখন তাকে জামিন প্রদান করা হয়।

২০০৯ সালে বর্ণাঢ্য গল্পদের সব পাঠ চুকিয়ে জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে পারি জমিয়েছিলেন অনন্ত লোকে।

সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেও তিনি হতদরিদ্রের হয়ে কথা বলেছিলেন এবং নিজের ব্যক্তিত্বের জোরে অন্য রাজপরিবার হতে পার্থক্যের সীমা টেনেছিলেন। একই সঙ্গে সৌন্দর্য, করুণা ও প্রতিকূলতার প্রতীক এই রাজমাতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

 

সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

susmi9897@gmail.com

Share if you like