সুন্দরবন মানেই দারুণ পর্যটন কেন্দ্র আর নয়নাভিরাম দৃশ্য নয়, সুন্দরবন মানে জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ। জীবন যেখানে অনিশ্চিত, রুটি-রুজির তাগিদে অনিশ্চিয়তার পথে পা বাড়াতে হয় এসমস্ত জনপদের মানুষকে। হয় ভাতে মরো, নয় বাঘের হাতে। গহীন বনে মধু আহরণ, গরান-গোলপাতা গাছ কাটা, মাছ শিকার করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এই বনেই বসবাস রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। সুতরাং প্রাণ হাতে করে নিয়েই বনে কাজ করতে যান সুন্দরবনের খেটে খাওয়া মানুষ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেন না ঘরে।
বাঘের আক্রমণ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের কাছে খুবই সাধারণ ঘটনা। আর একবার বাঘে ধরলে সে মানুষকে সচরাচর বাঁচানো যায় না সেটাও সর্বজনবিদিত। যে সমস্ত মহিলার স্বামী বাঘের আক্রমণে হারান প্রাণ, এসব মহিলাকে বলা হয় বাঘবিধবা। প্রাণখানা বাঘের হাতে গেলেও স্বামীর মৃত্যুতে সমাজ কিন্তু দোষ দেয় এসব নারীকে। এরা আখ্যা পান অপয়া বা অলক্ষুণের। অনেকক্ষেত্রেই তাড়িয়ে দেয়া হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। সুন্দরবনের জ্বলজ্যান্ত দুঃখ এই বাঘ-বিধবারা, যাদের জীবনে নেই রং-রস-ছন্দ, তাল-লয়-সুর।
“চাচী, কেমন আছেন?
-"এখনো মরি নাই। তুমি ভালো আছো?"
কথা হচ্ছিল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সুন্দরবন অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রাম দাতিনাখালীর এক বাঘ-বিধবার সাথে।
বাঘ-বিধবা কুলছুম বেগম (৮৫) জানান, মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে জিয়াদ আলী গাজীর সাথে, ঘর বাঁধেন দাতিনাখালী গ্রামে। স্বামী জিয়াদ গরান আর গোলপাতা কাটতেন বনে। মধু সংগ্রহ করতেন মধু কাটার মৌসুমে৷ মাঝেমধ্যে ধরতেন মাছ, কাঁকড়াও।
১৯৯৭ সালের মে মাসে জিয়াদ আলী গাজী মাছ ধরতে গিয়েছিলেন ৬ জনের একটি দলে। দলের অন্য সবাই ফিরলো। কিন্তু রাত পোহালেও তিনি আর ফেরেন নি। এরপর গ্রামের লোকজন বনবিভাগে খবর পাঠায়। উদ্ধার করা হয় ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ যার বামদিকের অংশবিশেষ নেই বললেই চলে, খেয়ে ফেলে সুন্দরবনের বাঘ।
কুলছুম বেগম আক্ষেপের সুরে জানাচ্ছিলেন তার জীবনগাঁথা। স্বামীর মৃত্যুর ৬ মাসের মাথায় মেয়ে রোকেয়া (১৬) যায় বাঘের পেটে। সেও বনে মাছ ধরতে গিয়েছিল এক দুপুরবেলা৷ পড়ে যায় বাঘের কবলে। বাঘ তার মাথা ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে।
পরপর স্বামী ও মেয়েকে হারিয়ে শোকে কাতর, এদিকে পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ে নিয়ে অসহায় এই বিধবা পড়েন অকূল পাথারে। গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন কুলছুম৷ সরকার থেকে মেলেনি বিশেষ কোনো সাহায্য। বেসরকারি সংস্থা লিডার্স থেকে মিঠা পানি সংরক্ষণের জন্য পেয়েছেন একটি পানির ট্যাংক, বিভিন্ন এনজিও থেকে টুকটাক ত্রাণ সহায়তা। বয়স্ক ভাতা পান তিনমাস অন্তর ১৫০০ টাকা। তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়া জোটে না, বয়স হলেও যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারেন না।
বেসরকারি সংস্থা লিডারসের পরিচালক মোহন কুমার দাস জানান, তাদের কাছে থাকা হিসাবমতে খুলনার কয়রা উপজেলায় বাঘ বিধবা আছেন ৭৫০ জন। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় এ সংখ্যা ১ হাজার ১৬৩। সুন্দরবন অঞ্চলে মোট বাঘ বিধবার সংখা ১৯০০-র বেশি। এরমধ্যে ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাঘের আক্রমণে মারা গেছেন ৫ শতাধিক বনজীবী।
সুন্দরবন অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে বসবাসরত বাঘ বিধবাদের সামাজিক মর্যাদা ও পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে অনির্বাণ, দুর্জয়, জাগ্রত বাঘ বিধবা, লিডারস প্রভৃতি সংগঠন। তবে অনেকক্ষেত্রেই এত বিশাল সংখ্যক বাঘ-বিধবাদেরকে সাহায্য প্রদান করা সম্ভব হয় না। বৈধ পাস থাকা বনজীবীদের নির্দিষ্ট সংখ্যক বিধবাদের তালিকা তৈরি করে এ সহায়তা প্রদান কার্যক্রম চলে৷
আরেকজন বাঘ-বিধবা ফাতেমা গাজী (৩৪) বললেন, ২০১০ সালের মার্চ মাসে তার স্বামী আব্দুস সামাদ গাজী গিয়েছিলেন বনে গোলপাতা সংগ্রহে। পড়েছিলেন বাঘের কবলে, ফিরলেন লাশ হয়ে, যে লাশের এক পা আর পাওয়া যায় নি। ছেলের বয়স তখন ৫ মাস, সাথে ৫ ও ৭ বছরের দুটি মেয়ে। শ্বশুরবাড়িতে জায়গা মেলে নি। বাপের বাড়িতেও ঠাঁই পান নি। স্বামীর কেনা ছোট্ট জায়গায় মাটি আর গোলপাতা দিয়ে ঘর বাঁধেন। দিনমজুরি আর কাঁথা সেলাই করে সংসার চালিয়েছেন।
বর্তমানে ডায়াবেটিস, জরায়ু টিউমারসহ নানা রোগে ভুগছেন। তিনি অসুস্থ থাকার দরুন ছেলে মাছ ধরে সংসার চালায়। ওষুধ কিনতে গিয়ে দুই হাট কিছুই বাজার করতে পারেন নি।
সরকার থেকে বাঘ-বিধবাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ যে টাকা দেয়া হয় তা পেয়েছেন কিনা প্রশ্ন করলে ফাতেমা জানান, এমন কিছুই পান নি তিনি৷ তিনি অশিক্ষিত মানুষ। আবেদনের নিয়মকানুন বোঝেন না। এ ব্যাপারে সাহায্য করবার মতোও কেউ নেই। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে টুকটাক সহায়তা পান। আর রয়েছে বিধবা ভাতার কার্ড। ফাতেমা গাজী আবেদন জানালেন বিধবা ভাতার টাকাটা তিন মাস অন্তর ১৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০০ করা গেলে খেয়েপরে বাঁচতে পারতেন আরেকটু ভালোভাবে।
সুন্দরবন উপকূলের গ্রামগুলোতে এমনিভাবেই গড়ে উঠেছে বাঘবিধবা পল্লী। এসব পল্লীতে বিধবা নারীদের করুণ আর্তি ভেসে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে। এসব মানুষের জীবনে নেই উৎসব-পার্বণ, নেই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। আছে শুধু হাহাকার আর না পাওয়ার মর্মবেদনা।
দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাতে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ভুলে এরা আবারো অন্য কোনো প্রিয়জনকে পাঠায় বনে। যেভাবে আমিরুন নিসা (৫০) স্বামী মতলব সানার মৃত্যুর পর ছেলে মোশারফ সানা (১৮) কে পাঠিয়েছিলেন বনে। বাবার মৃত্যুর পর সংসার চালানোর তাগিদেই এই কাজ করতে হতো মোশারফকে। বাবার মৃত্যুর ৭ মাসের মাথায় মোশারফও বাঘের কবলে প্রাণ হারায়। বছরখানেকের মধ্যে ছেলে আর স্বামী হারানোর গল্প বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করছিল আমিরুন নিসার। এখন ভরসা বিধবা ভাতার কখানা টাকা আর দিনমজুরের কাজ।
সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক এমকেএম ইকবাল হোসেন জানান, বাঘের আক্রমণে স্বামী নিহত হলে এবং বনে প্রবেশের বৈধ পাস থাকলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাৎক্ষণিক ৫০ হাজার টাকা এবং পরবর্তীতে ৩ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। বণ্যপ্রাণী দ্বারা আক্রান্ত জানমালের ক্ষতিপূরণ নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী এ সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তি বনে প্রবেশ করে থাকেন অবৈধভাবে। সেক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। গত ৩ দিনে ১৮ জন অবৈধ প্রবেশকারী বনজীবীকে আটক করে কোর্টে চালান দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো জানান, খুলনার কয়রা উপজেলার কোবাদক স্টেশনে বাঘবিধবাদেরকে মাছ ধরবার জন্যে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে ‘মায়ের খাল’। সেই জলাধারে বাঘবিধবারা মাছ ধরতে পারেন বৈধ পাস নিয়ে। এ খালকে স্থানীয় লোকজন কিছুদিন আগেও ডাকত 'সন্ন্যাসী খাল’। কিন্তু এখানে নারীরা মাছ-কাঁকড়া ধরতে নামছেন বলে নাম বদলে রাখা হয়েছে মায়ের খাল। ২১ জন বিধবা পেয়েছেন বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট)। ২১ জনের মধ্যে ৫ জন নারীকে দেয়া হয়েছে মায়ের খালে বৈধভাবে মাছ ধরার পাস।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, বৈধ পাসযুক্ত কোনো ব্যক্তি বাঘের আক্রমণে নিহত হলে পরিবার থেকে আবেদন করতে হয়। সেক্ষেত্রে আবেদনকৃত পরিবারকে বনবিভাগের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেয়া হয়। আবেদন করে টাকা পান নি এমন ব্যক্তির ব্যাপারে তিনি জানতে পারলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সুন্দরবন পশ্চিম) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, ২০১১-২০২২ সাল পর্যন্ত গত ১১ বছরে বনবিভাগের হিসাব অনুযায়ী ৬২ জন বনজীবী বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন, আহত হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে ২০১১ সালে নিহত হন ২৭ জন, ২০১২ সালে ২৯ জন, ২০১৩ সালে ১ জন, ২০১৭ সালে ১ জন এবং ২০২১ সালে ৪ জন। বিগত ১১ বছরে আহত এবং নিহত সর্বমোট ৮১ জন ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয়েছে ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
বৈধ পাস থাকুক কিংবা না থাকুক বাঘের আক্রমণে যেসব নারী হারিয়েছেন স্বামী-সংসার, সরকারিভাবে এদেরকে তালিকার আওতায় এনে পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানের চেষ্টা জরুরি। বিশেষ করে বাঘ-বিধবা ভাতার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। পাশাপাশি অবৈধভাবে বনে প্রবেশকারীদের ওপর কঠোর নজরদারি চালাতে পারলে বাঘের কবল থেকে বেঁচে যেতো অন্তত কিছু জীবন।
বাঘ-বিধবাদের গল্পগুলো শুধু সংবাদপত্রের পাতায় আবদ্ধ না থেকে দৃষ্টি কাড়ুক উধ্বর্তন মহলের। শুধু পাসভিত্তিক নয়, বাঘের কবলে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির অসহায়, সামাজিকভাবে একঘরে সমস্ত বাঘ-বিধবা পাক সহায়তা। সুন্দরবনের বেদনার নীলাভ শিখা বাঘবিধবারা শুরু করুক নতুন জীবন,কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের, কিছুটা কম কষ্টের।
অনুস্কা ব্যানার্জী শ্রাবস্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন।