বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে নবীন মেঘের এক পশলা বৃষ্টির মতো আগমন ঘটে সুনিধি নায়েকের। সহজিয়া সুরেলা কণ্ঠে শান্ত অথচ মন হারানো সুরে হৃদয় ভিজিয়ে দিয়ে যান শ্রোতাদের। প্রেম সুধারসে মাতাল হয়ে সম্প্রতি হয়েছেন বাংলাদেশের বধূ। গানের পাশাপাশি ঘরকন্নাতেও আছেন সমান তালে। তার সাথে এক আলাপে শোনা হলো তার গল্পের পসরা।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হাত ধরে বেড়ে ওঠা। একদিন সেখানেই এক গানের আসরে একটি ছেলে গান ধরলো, 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই', দ্বিতীয় চরণ হতে। মেয়েটির গোড়া মানসিকতা মনে মনে সেই ছেলেটিকে বহিষ্কারের খাতায় ফেলে দিচ্ছিল। 'না এর গান তো জীবনে শোনা যাবে না, কবি গুরুর গানের এহেন অপমান!' সেইটে ছিল গান শেখা পাঠের প্রথম বর্ষ। এরপরে কেটে যায় সাতটি বছর। একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে গাইছিল মেয়েটি। সেদিনের সেই ছক ভাঙা ছেলেটি মঞ্চে উঠে তাকে অভিবাদন জানিয়ে বললো, 'খুব ভালো গেয়েছিস!'
তারপর আর কী, দিনে দিনে সেই ছেলেটির কাছেই হৃদয় সমর্পণ, চার হাতের এক হওয়া।
এইভাবেই শুরু অর্ণব-সুনিধির গল্প। যাদের ভালোবাসা জুড়ে দিয়েছে দুটি দেশের সীমানা।
বাংলাদেশে পদার্পণ বধূ হয়ে অর্ণবের হাত ধরে। নতুন একটা পরিবেশ, ছিল না তেমন চেনা জানা কেউ, অর্ণবের বন্ধুদের সাথেই প্রথম বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে আরো হলো গানের বন্ধু , অভিনয়ের বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পর্যায়ের বন্ধু।
সুনিধি জানালেন, এখন বেশ ভালোই আছেন বাংলাদেশে। খুব ভালো চলছে দিন। আরো বললেন, "অর্ণব আর আমার শুরুটা বেশ অপ্রত্যাশিত ছিল। সেইদিনগুলির শুরুতে আমি পুরোপুরি কাজে মগ্ন ছিলাম। তখন অর্ণবকেই চিনতাম না। খুব অবাককর বিষয়, অর্ণব এটা এখনো বিশ্বাস করে না।"
প্রথম প্রথম প্রেমে সব ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। দেশ কালের সীমা মানেননি। কিন্তু নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে বিস্তর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন দুটো জায়গাই সমানভাবে প্রিয়। কলকাতায় গেলে এখন তার বাংলাদেশের বন্ধু, ভুনা খিচুড়ি আর বিরিয়ানির জন্য মন উচাটন হয়। সুনিধি বলেন,"বাংলাদেশের বিরিয়ানি কলকাতার বিরিয়ানি হতে ভালো - এটা এককথায় মানতেই হবে।"
তবে ঢাকাতে এলে বাবাকে খুব মনে করেন সুনিধি। মা চলে গেছেন বছর দুয়েক হয়। মায়ের কথায় সুনিধি ফিরে যান ছোটকালের স্মৃতিকাতর দিনে। সুনিধির যখন গান শেখার শুরু তখন তার বয়স সবে তিন। হারমোনিয়ামে প্রথম গান করা। বাজাতে পারতেন শুধু রিড, বেলো অব্দি পৌঁছতো না হাত। মা তখন তার ছোট্ট সোনামণিকে বেলো টেনে দিতেন।
ঢাকাতে প্রথম প্রথম ওপারের কলেজের বন্ধু-বান্ধবদের খুব অভাববোধ হতো, কেননা জীবনের সব ছোটো বড় ঘটনা ওদের সাথেই আগে ভাগ করে নিতেন, ওদেরই খুব কাছের মনে হতো। এখন মোটামুটি মানিয়ে গেছেন ঢাকার সাথে।
সমুদ্র সুনিধির বেশ প্রিয়। বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। খুলনা, ময়মনসিংহ, ঢাকায় বেশ কিছু জায়গা গিয়েছেন শো - এর ডাকে।
বাংলাদেশে এসে এক নতুন কর্মজগতে প্রবেশ। নতুন নতুন গানের ধারার সাথে পরিচিতি। নতুন নতুন সহকর্মী তথা সহযোগী। এই পরিবর্তনগুলি সুনিধি যেমন মানিয়ে নিয়েছেন, তেমনি উপভোগ করছেন বেশ। সুনিধি বলেন, বাংলাদেশে ভালো ভালো সংগীতজ্ঞ আছেন, প্রথমে বাংলাদেশে শান্তিনিকেতনের বন্ধুদের খুব মনে হতো। কিন্তু এখানে শুভ, সাদ, ইমরান -এদের নিয়ে শুরু হলো নতুন পথ চলা। এখন বলা যায় আমরা একটা ব্যান্ড।
বাংলাদেশে যারা নতুন গান করছে তাদের মধ্যে অনিমেষ রায় আর রিপন কুমার সরকার ওরফে বগা তালেব সুনিধির খুব প্রিয় মানুষ। সুনিধি বলেন, "অনিমেষ খুব ভালো মানুষ এবং ভালো একজন বন্ধু।" আর বগার সাথে সুনিধির পরিচয় সেই বিশ্বভারতীর দিনগুলি হতে। শিক্ষাজীবনের এই কনিষ্ঠকে কোক স্টুডিওর মঞ্চে আনার প্রস্তাবটি সুনিধিই করেছিলেন অর্ণবকে।
কাজের জায়গায় সুনিধির সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে তা হলো ব্যক্তিগত জীবনটাকে একপাশে রেখে কাজের সময় শুধু কাজের কথা ভাবা, যেটা আসলে খুব সম্মান করার মতো। একটি নিরপেক্ষ দৃষ্টি হতে বাংলাদেশের গিটার বাদকদের প্রশংসা করে বললেন, এখানের শিল্পীরা পাশ্চাত্য জ্যাজ আর ব্লুজ ধরনের গানের ভিন্ন রকম পরিবেশনা করেন, যেটা কিনা কলকাতাতে আগে দেখা হয়নি।
শিল্পী জীবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে প্রবেশ। তাই আমজনতার ধারণা বনে গেছে তিনি হয়তো বা শুধু রবি ঠাকুরের গানেই অভ্যস্ত। এটি সম্পূর্ণ সত্য নয় বলে জানিয়ে দিলেন সুনিধি। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বললেন, রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পর্ক মোটে পাঁচ থেকে ছ’বছরের। গোটা সতের বছর ধরে করেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা, যার তালিম নেয়া পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছ থেকে। কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীত করতেই বরাবর ভালোবাসতেন। এই জন্যে শুধু তাকে ওই ঘরানার গায়েন ভাবা হয়। এই প্রসঙ্গে সুনিধির মত, "কেউ যদি শাস্ত্রীয় সংগীত একবার শেখে, তাহলে সে যেকোনো গান গাইবার দক্ষতা রাখে।"
বিশ্বভারতীর দিনগুলি নিয়ে সুনিধির একটা ঘটনা মনে পড়ে প্রায়ই, যা নিয়ে তিনি এখন বেশ অবাক হয়ে ভাবেন। তখন সবে প্রথম সেমিস্টার। আর দশজন শিক্ষার্থীর থেকে সুনিধি চাইতেন বরাবরই এগিয়ে থাকতে। কিন্তু সেবারে প্রথম ফল বের হবার পরে মুখটা হয়ে গেলো বাংলার পাঁচ। এতো কম নম্বর পেলেন যে মেনে নিতে পারেননি কিছুতেই। মনটা তার তখন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পরের সেমিস্টার হতে নিজেকে ভালোই গুছিয়ে ফেলেন। এখন সুনিধি সেই ঘটনা মনে করে ভীষন হাসেন। বলেন, "এখন আমি আসলে মানে খুঁজে পাই না, তখন আমি কেন এমন করতাম।"
বাংলাদেশে সুনিধি-অর্ণব দম্পতি সাম্প্রতিক বড় রকমের অবদান রেখেছেন কোক স্টুডিও বাংলায়। তাই সিজন এক- এই বিশাল আয়োজনের এক খানা ছোটো খাটো সময় ভ্রমণ করালেন সুনিধি। কোক স্টুডিওকে সাজাতে শুরু করেন ২০২১ এর অক্টোবর হতে। ইন্ডিয়া টিম, পাকিস্তান টিমের সাথে বহু মিটিং। দু মাস ধরে চললো শুধু এই মিটিং। তখনই মোটামুটি ঠিক হয়ে যায় মোট ১০টির মতো গান আসতে চলেছে।
কোক স্টুডিওর পরিচয়ই ফিউশন গানে। এখানে মিশেছে আধুনিকের সাথে শাস্ত্রীয় আর লোকজ সব গান। সবই নতুন ভাবে, সকল গাম্ভীর্যের দেয়াল ভেঙে। তবে এই সকল ভিন্নধর্মী পরিবেশনায় প্রশ্ন তুলেছে কিছু নেতিবাচক মহল। সেই প্রশ্নের জবাবটা সুনিধি ভারী যত্নেই দিলেন। তার ভাষ্যে ফিউশনের মতটি ছিল কোক কোম্পানির।
কোনো একটি গান যদি শুধু তার ট্রেডিশনাল স্টাইলে করা হয়, তাহলে সেটি অনেক দর্শক শ্রোতা হারায়, কেননা আজকের দিনের আধুনিক ভাবধারা তাদের সেকেলে গান হতে বিমুখ করে। তাই উপস্থাপিত করতে হলে তাতে জুড়তে হয় নতুনত্ব। এটি আসলে বর্তমানকে গুরুত্ব দেয়া। নতুন সময়ের পছন্দকে মাথায় রাখা। শুধু তাই নয়, যুগের প্রয়োজন মাথায় রেখে দুটি ভিন্ন সময়ের গানকে একইসাথে বাঁচিয়ে রাখা। নতুন তারুণ্য তাদের কীভাবে নেবে, কোন বাদ্যে নেবে, কোন পরিবেশনায় গ্রহণ করবে এই নিয়ে করতে হয়েছে বিস্তর গবেষণা- যার ফসল হলো এই কোক স্টুডিও বাংলার ফিউশন গানগুলি।
বাংলাদেশে আসার পরে সুনিধির অনেক ভক্ত মুখিয়ে তার নতুন এলবাম বের হবে কবে। সুনিধি তার গানের আসন্ন এলবাম নিয়ে জানালেন, কাজটা ধরেছিলেন গেল বছরের অক্টোবরে, যখন ধারে কাছে ছিল না কোক স্টুডিও। ইমরান আহমেদ আর শুভেন্দু দাস শুভর সাথে জ্যাজ মিউজিকের সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীতের মিশেলে নতুন ধারার কিছু করার কথা ভাবছিলেন।
পরিকল্পনা ছিল ৬টি গানের এলবাম হবে যার সব কয়টি সুনিধির বেশ পছন্দের। তার তিনটা গান রেকর্ড হয়ে যাবার পরে যখন চার নম্বর গানের মহড়া চলছিল, তখন অর্ণব হাতে নিয়ে ফেললেন কোক স্টুডিওর কাজ। অগত্যা ইমরান, শুভ ,সুনিধি সবাই মিলে যান তাতে। এদের ধ্যানজ্ঞান হয়েই এগোতে থাকে কোক স্টুডিও। সেই থেকে থেমে আছে সুনিধির এলবামের কাজ। এখন একটু সময় পেলেই সেটি বের করার কাজে হাত দেবেন বলে আশাবাদী তিনি।
কাজের চাপে এখন আর অর্ণবের সাথে নতুন কোনো মিউজিক ভিডিও নিয়ে বসতে পারছেন না। চাপ কমলে এদিকটাতেও এগোবেন বলে ইঙ্গিত করলেন।
শিক্ষা জীবনের রেশে সুনিধি ক্লাসিক্যাল গান করতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তার প্রিয় বাদ্য এস্রাজ আর তানপুরা। কিন্তু আধুনিক যন্ত্রে গিটার বেশ ভালো লাগে। তিনি বিছানার পাশে রেখেছেন পিয়ানো। রাতের বেলা শুতে যাবার আগে পিয়ানোতে খেলে দিয়ে যায় তার আঙ্গুল। এটা সুনিধির নতুন ঘরে একটা নতুন আবেগ, মানসিক প্রশান্তি।
সুনিধি বর্তমানে ব্যস্ত আছেন জ্যাজ গানের হাতেখড়িতে। এর পেছনে তাকে সময় দিচ্ছেন বন্ধু ইমরান। এই ধাঁচে আনতে চাচ্ছেন নতুন গান। সুনিধি বলেন, "এই মিউজিক আগে শোনা হয়েছে প্রচুর কিন্তু সেটা কাজ করা হয়ে ওঠেনি। তাই চেষ্টা করছি এটার ফিউশনে কিছু করা যায় কিনা।"
সুস্মিতা রায় বর্তমানে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজে ৪র্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন।