আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনার মধ্যেই দেশে ব্যাংক ঋণে সুদ হারের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়ার বিষয়ে নতুন করে পর্যালোচনা শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
তবে ৯ শতাংশের ওই সীমা একবারে তুলে না দিয়ে কোন কোন খাতে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না এলেও বিষয়টি পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “৯ শতাংশের সীমা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে, আগেও বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদন খাতে সুদহারের ৯ শতাংশের সীমা ঠিক রেখে অন্য কোন কোন খাতে তা বাড়ানো যায়, তা ভাবা হচ্ছে।
এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে এসএমই ও ব্যক্তি খাতে, অর্থাৎ ভোগ্য পণ্যর বিপরীতে দেওয়া ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া বা বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।
সুদহারের সীমা তুলে দিলে অর্থর্নীতিতে এর প্রভাব কেমন হতে পারে, সে বিষয়টিও পর্যালোচনায় রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক খাতে সুদের হার ঋণে সর্বোচ্চ ৯ ও আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ কার্যকর আছে। ব্যবসায়ীদের একটি পক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে সুদহার বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোতে বেশ পরিবর্তন এসেছে।
এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে তিনবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়িয়ে কেবল রেপোর সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ কতটা কাজে লাগছে, সেই প্রশ্ন রয়েছে অর্থনীতিবিদদের।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক সেমিনারেও সুদ হারের ওই সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
গত ২৭ অগাস্ট বিআইবিএম এর ‘নবম বার্ষিক ব্যাংকিং কনফারেন্স’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল উপস্থাপিক মূল প্রবন্ধে বলা হয়, মুদ্রাবাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে মুদ্রানীতিতে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির চাপে ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া মানে হল, অর্থ পরিশোধ কমে যাবে ব্যাংকে। যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সেদিনও বিআইবিএম প্রাঙ্গনে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “সুদহার সীমা তুলে দিলে অর্থ খরচ আরও বাড়বে উদ্যোক্তাদের। পাশাপাশি ব্যাংকেরও তহবিল ব্যবস্থাপনার খরচ বৃদ্ধি পাবে। আমরা উদ্যোক্তাদের কম খরচে ঋণ দিতে চাই। যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে।”
সরকার যখন ওই সুদহার বেঁধে দেয়, তার আগে ২০২০ সালের মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, যা ওই সময়ের আগের ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর পর থেকে মূল্যস্ফীতির পারদ শুধু উপরের দিকেই উঠতে দেখেছে বাংলাদেশে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এ বছর অগাস্টে এই হার ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে উঠে যায়। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়।
এ অবস্থায় ব্যাংকে টাকা রেখে লোকসান হচ্ছে আমানতাকারীদের, কারণ তারা যে হারে সুদ পাচ্ছেন, মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছিল, তিন মাসের গড় মূল্যস্ফীতির উপরে থাকতে হবে আমানতের সুদের হার। কিন্তু বাস্তবে তার কার্যকারিতা নেই। গত সেপ্টেম্বর শেষেও ব্যাংকে আমানতের সুদহার ৪ শতাংশের ঘরেই ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মূল্যস্ফীতির এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে অর্থনীতিবিদরা ঋণের ৯ শতাংশ সুদ হার তুলে দিয়ে আমানতের সুদহার বাড়ানোর পক্ষে মত দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইমএফ) প্রতিনিধি দলের চলমান সফরের মধ্যে বিষয়টি ফের আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
মহামারীর পর ইউক্রেইন যুদ্ধের জেরে পৃথিবীর অনেক দেশের মত বাংলাদেশও বিভিন্ন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। জ্বালানি সঙ্কট ও মূ্ল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগতি হয়ে উঠেছে মাথাব্যথার বড় কারণ।
এ পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় আইএমএফ এর কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে চায় বাংলাদেশ সরকার। সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিরা বর্তমানে বাংলাদেশ সফর করছেন। দেশের আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য আইএমএফ এর নানা শর্ত দেওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠকেও ব্যাংক ঋণের সুদ হারের সীমা তুলে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলও ওই সীমা তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বলে খবর এসেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য দুই মাস আগেও বলেছিলেন, ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর পক্ষে তিনি নন।
১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের মতো দেশে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। ব্যাংক খাতে সুদের হার ৯ ও ৬ শতাংশ যেভাবে কার্যকর করেছি, তা ভালোভাবেই চলছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্ব ও মুদ্রানীতি কাজে লাগানো হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই কাজটি করে থাকে।”
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতিও (এফবিসিসিআই) সুদ হারের ওই সীমা তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে।
এ সংগঠনের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গত ৫ নভেম্বর এক সভায় বলেন, সুদহার বাড়ালে ঋণগ্রাহক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা আরও বেশি চাপে পড়বেন। শিল্পের উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বাড়বে। কোভিডের সংকট পার করে, এখনো বাড়তি চাপ সামলানোর পরিস্থতি তৈরি হয়নি।
“সুদহার বাড়ালেই অর্থনীতিতে চলমান মূল্যস্ফীতিসহ সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। বিকল্প হিসেবে সুদহার না বাড়িয়ে ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।”