সেদিন ছিল বসন্তের এক সুন্দর সকাল। ডানউন হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ৩২৫ জন শিক্ষার্থী চোখে জেজু দ্বীপ ঘুরে দেখার স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষকদের সাথে উঠে বসে এমভি সিউল নামক ফেরিতে। তবে কে জানতো কারো কারোর জন্য এই যাত্রাই হতে চলেছে তাদের জীবনের শেষযাত্রা?
১৬ই এপ্রিল ২০১৪, ইঞ্চন শহর থেকে জেজু দ্বীপের উদ্দেশ্যে ৪৭৬ জন যাত্রী নিয়ে রওনা দেয় এমভি সিউল নামক একটি ফেরি বা জাহাজ। তবে দুর্ভাগ্যবশত গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বেই ডুবে যায় ফেরিটি।
যার সাক্ষী হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় প্রতিটি নাগরিক। কারণ পুরো ঘটনাটি সরাসরি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার করা হয়।
সিউল ফেরি ট্রাজেডি দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসের এমন একটি দুর্ঘটনা যার আঘাত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে দেশটির আপামর জনগণ। তবে এটিকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে। কেন ভুল হবে তার উত্তর পেতে চলুন জানা যাক আসলে কী ঘটেছিল সেদিন।
সেদিন সকাল ৮টা ৪৯ মিনিট নাগাদ এমভি সিউল ফেরিটি ডুবতে শুরু করে। ৮টা ৫৩ মিনিটের আশেপাশে ইন্টারকম থেকে সবার জন্য একটি নির্দেশনা ভেসে আসে, যেখানে কাউকে জায়গা থেকে না নড়তে এবং স্থির থাকতে বলা হয়। পাশাপাশি একটি নারী কণ্ঠ সবাইকে স্ট্যান্ড বাই অবস্থায় থাকার জন্য অনুরোধ জানায়।
কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এরকম নির্দেশনা পেয়ে শিক্ষার্থীরা ভেবে বসে যেকোনো ভাবে ফেরি থেকে তাদের উদ্ধার করা হবে এবং সুস্থভাবে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হবে। তাই তারা নিজ থেকে ফেরি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়াস না করে যে যার জায়গায় অবস্থান করে।
কিন্তু তারা জানতোই না ফেরিটিতে কি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে।
ভাগ্যদেবতা সেদিন সুপ্রসন্ন ছিলেন না। কারণ সরকার থেকে শুরু করে জাহাজের ক্যাপ্টেন সবাই উদ্ধার অভিযানে দেখিয়েছেন গাফিলতি। নিজ দায়িত্ব পালনে সবাই ছিলেন নড়বড়ে। এই দায়িত্বহীনতা-ই মৃত্যুর পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে। এমন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হত্যার-ই সামিল।
জাহাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটি চালনাকারী ক্যাপ্টেন। যাত্রীরা এই ক্যাপ্টেনের উপর ভরসা করেই সাগর পথে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই ক্যাপ্টেন-ই যদি জাহাজটিকে দুর্ঘটনার কবলে ফেলে আগে পালিয়ে যায় তবে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে।
এমভি সিউল এর ক্যাপ্টেন ঠিক এমনটাই করেছিলেন। সকাল ৯টা ৪৭ নাগাদ পরবর্তী কোনো নির্দেশনা প্রদান না করেই পেট্রোল বোটে করে ক্যাপ্টেন পালিয়ে যান। তখনও ফেরিতে ছিল অর্ধেকের বেশি যাত্রী। তাদের একরকম মৃত্যুমুখে পরিত্যাগ করে তিনি চলে যান।
উদ্ধার অভিযান জোরদার করার পরিবর্তে সরকারি সংস্থাগুলো বারবার জাহাজের অভ্যন্তরে ক্যামেরা পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিল। যাতে করে তারা অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট করতে পারে।
ফেরিটি ডুবতে শুরু করার প্রায় এক ঘন্টা পরে সেখানে শুধুমাত্র একটি পেট্রোল বোট উদ্ধার অভিযানের জন্য পৌঁছায়। প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে শুরু করে কোস্টগার্ড অফিস, সিচুয়েশন রুমের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই চলে যায় অনেকটা সময়।
আবার জিনডো ভেসেল ট্রাফিক সার্ভিস ও সিউল ফেরির মধ্যে যে কথোপকথন হয় তার মূল বক্তব্য ছিলো ফেরির ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করেই উদ্ধার কাজ পরিচালিত হবে।
কিন্তু পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত প্রদান না করেই পেট্রোল বোট যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি পলায়ন করেন। তার মতো ফেরিতে থাকা ক্রু সদস্যরাও পালিয়ে যায়।
৪৭৬ জন যাত্রীর মধ্যে ৩০৪ জন মারা যায়। যার মধ্যে ছিলেন পর্যটক, উদ্ধারকর্মী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। কিন্তু মারা যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি ছিলো শিক্ষার্থীরা। ৩২৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৫০ জন মারা যায় এবং ৭৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। সর্বমোট উদ্ধার করা হয় ১৭২ জন যাত্রীকে।
ঘটনার পর দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চুং হং উন পদত্যাগ করেন। সিউলের কেন্দ্রীয় জেলা আদালত ফেরি দুর্ঘটনার সাথে সরকারের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ পাওয়ার পর সরকার ও ফেরি অপারেটর চংহাইজিনকে ২০০মিলিয়ন ওন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রদানের নির্দেশ দেন।
২০১৪ সালের ১৫ই মে ফেরির ক্যাপ্টেন ও তিন জন ক্রু সদস্যকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আদালতে পেশ করা হয়। এবং বাকি ১১জন ক্রু সদস্যদের ফেরি পরিত্যাগ করে চলে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য এমভি সিউলের ক্যাপ্টেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ চেয়েছিলেন সবাইকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হোক কিন্তু আদালত ফেরি ডুবে যাওয়ার আরো অন্যান্য পার্শ্ব কারণ (যেমন: ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি পণ্য দিয়ে ফেরি বোঝাই করা, ফেরির স্টিয়ারিং ক্রু সদস্যদের অনভিজ্ঞতা) দেখিয়ে ক্যাপ্টেন ও তার সঙ্গীদের কারাদণ্ড প্রদান করেন।
১৬ই এপ্রিল দিনটি এলেই আজও দক্ষিণ কোরিয়ার আকাশ শোকে ভারী হয়ে ওঠে। সন্তান হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে উঠেন প্রতিটি পরিবার।
ফারজানা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।