Loading...
The Financial Express

সারপা সালপা: যে মাছটি নিয়ে যেতে পারে তীব্র আতঙ্কের জগতে

| Updated: October 02, 2022 17:50:55


সারপা সালপা। ছবি: ব্রায়ান গ্র‍্যাটউইক সারপা সালপা। ছবি: ব্রায়ান গ্র‍্যাটউইক

কী যেন হয়ে গেল হঠাৎ! আর স্বাভাবিক নেই আপনি। মাথার ভেতর যেন সাঁই সাঁই করে ঝড় বয়ে চলছে, আর সাথে সাথে চোখ হয়ে পড়ছে ঝাপসা; সামনে দেখছেন এমন কিছু যা বাস্তব পৃথিবীতে সম্ভবই নয়। এভাবে কল্পলোকের গল্পগুলোর মত ঘটনাবলি ভেসে উঠছে মাথায়। শরীর অবশ হয়ে আসছে, আর সাথে সাথে বোধ করছেন তীব্র বমিভাব।

না, কোনো নেশাদ্রব্য সেবন করেননি। কিন্তু এসব কিছু তারপরও ঘটা খুবই সম্ভব, যদি কেউ খেয়ে ফেলেন সোনালি সেই মাছটি। মাছটির নাম সারপা সালপা। মাছটির গায়ে সমান্তরালে থাকা লম্বা সোনালি দাগগুলো দেখে একে সহজেই শনাক্ত করা যায়।

সালেমা পোরগি নামে স্বাভাবিকভাবে পরিচিতি আছে এর। সারপা সালপা কথাটি আরবি থেকে এসেছে; যার অর্থ 'মতিভ্রমকারী মৎস্য'। 

ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে আটলান্টিক সাগরের উপকূল পর্যন্ত মিলতে পারে এর দেখা। সোনালি ওই দাগটা খেয়াল না করলে খুব সহজে চেনা যায় না। তবে এর সুন্দর দেহটি দেখে মনোলোভা মনে হলেও খাবার হিসেবে এটি সুবিধার নয় মোটেই।

ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়াতে থাকা সারপা সালপা। ছবি: লার্স বেহনকে

এই মাছটি 'হ্যালুসিনোজেন' অর্থাৎ হ্যালুসিনেশন সৃষ্টিকারী হিসেবে কাজ করে। এর ইতিহাস অবশ্য বহু পুরনো৷ রোমান সাম্রাজ্যে মতিভ্রমকারী ওষুধ হিসেবে এর প্রয়োগ ছিলো। আবার বিভিন্ন উৎসবে পলিনেসিয়ানরাও একে উপভোগ করতো খাবার হিসেবে। তারপর মোহগ্রস্থের মত তারা অলীক এক জগতে প্রবেশ করে বিভোর হয়ে থাকত নেশা কেটে যাবার আগপর্যন্ত।

ইদানীং এই মাছটি কেউ খায় না। তবে এটি যে মতিভ্রম করতে কতটা সক্ষম, তার একটি মোক্ষম উদাহরণ পাওয়া যায় ২০০৬ সালে 'ক্লিনিকাল টক্সিকোলজি' জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে।

সেই লেখাটি থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে বছর চল্লিশের এক লোক সারপা সালপার ভাজা খান। তখন ফ্রেঞ্চ রিভেইরায় ছুটি উদযাপন করছিলেন তিনি। এরপর উদভ্রান্ত দৃষ্টি, পেশির দুর্বলতা ও বমিভাব হতে থাকে তার। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়লে গাড়ি চালানোর মত মাঝরাস্তাতেই প্রায় অবশ হয়ে পড়ে তার শরীর। তিনি দেখেন সুবিশাল অনেকগুলো পতঙ্গ তার চারপাশ ঘিরে উড়ছে, চারপাশে হিংস্র পশু গর্জন করছে। কোনোরকম গাড়ি চালিয়ে তিনি হাসপাতাল পৌঁছান। ৩৬ ঘণ্টা পর তার অবস্থা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু তারপর তিনি বিগত দেড়দিনে ঘটা কোনোকিছুই মনে করতে পারেননি।

তবে ঘটনা শুধু এই একটি নয়। ২০০২ সালে একই অঞ্চলেই ঘটে আরেকটি ঘটনা। সেন্ট ট্রোপেজ থেকে মাছটি কিনে ভালো করে ধুয়ে কেটে-কুটে সুন্দর করে রান্না করে পেটে চালান করেন নব্বই বছরের এক বৃদ্ধ। তারপর মতিভ্রম ঘটে তার। দেখতে পান চোখের সামনে আতঙ্কে কাঁপছে হাজার-হাজার মানুষ। কিচির মিচির করে মাথার ওপর উড়ছে হাজার হাজার পাখি। তারপর দু'রাত তিনি প্রচণ্ড ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখতে থাকেন ঘুমের মধ্যে৷ কিন্তু কাউকে জানাননি সংকোচে। ভেবেছিলেন হয়ত সব তারই মনের দুর্বলতা, বয়স তো আর কম হয়নি। কিছুদিন পর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়।

এমন কুখ্যাত হ্যালুসিনেশন ঘটতে থাকার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইকথিয়োআলিইনোটক্সিজম। সুনির্দিষ্ট কোন মাছ খাওয়ার ফলে বিষক্রিয়া থেকে এমন হয়। তবে এটি দেখা যায় খুবই কম ক্ষেত্রে। রিফ বল ফাউন্ডেশনের সমুদ্র প্রাণিবিজ্ঞানী ক্যাথেরিন জ্যাডোট তার ডক্টরাল গবেষণায় এই মাছটির প্রতি মনোযোগ দিয়েছিলেন, তিনি দেখেছিলেন এই মাছে থাকা রাসায়নিক উপাদান এমনভাবে স্নায়ুতন্ত্রকে সংক্রমিত করে, যার সাথে তুলনা হতে পারে কুখ্যাত মাদক এলএসডি-র।

পসাইডোনিয়া ওশেনিয়া- এই ঘাসের ফাইটোপ্লাংটনই বিষের উৎস। ছবি: ইয়োরুনো

তবে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে কেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই মাছটি যারা খান, তাদের সবার এমন অনুভূতি হয় না? তাছাড়া এই মাছটি যে গণভুক্ত, সেই একই গণের আরো বিভিন্ন মাছে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়নি৷ তাহলে এই মাছটি ঠিক কারণে এমন হয়ে উঠলো তা কিন্তু সহজে শনাক্ত করা যায়নি।

২০১২ সালে ভিট্রো সেলুলে ও ডেভলপমেন্টাল বায়োলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, এই মাছটি মূলত সাগরের ঘাস 'পসাইডোনিয়া ওশেনিয়া'কে ফাইটোপ্লাংকটন হিসেবে গ্রহণ করে। এর ফলে এর ভেতরে থাকা বিষাক্ত পদার্থগুলো চলে যায় মাছটির পাকস্থলিতে। আর এই বিষ মাছের শরীর থেকে বেরোয় না। খুব ভালো করে তাপে ফোটালে বা মসলা দিয়ে মেখে নিয়ে রাঁধলেও তা রয়ে যেতে পারে। আর তারপর মাছটি খাওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যাবে দুঃস্বপ্নের প্রহর।

কিন্তু সেই বিষাক্ত পদার্থটি কী তা ঠিক শনাক্ত করা যায়নি। হতে পারে সেটি ইন্ডোল গ্রুপভুক্ত কোনো অ্যালকালয়েড। মাছটি যেসব শৈবাল ও ফাইটোপ্লাংটন খায়, সেসবে এমন রাসায়নিক উপাদান থেকে থাকে। আর রাসায়নিকভাবে এই অ্যালকালয়েডগুলোর গঠন এলএসডি ড্রাগে থাকা রাসায়নিক কিংবা অন্য আরেকটি হ্যালুসিনোজেন ডিমেথলিট্রিপথামিন ( ডিএমটি) এর মতো। ডিএমটি পাওয়া যায় ব্যথানাশক ড্রাগ ব্রিউ আয়াহুয়াসিয়া-তে।

ডিএমটি স্ফটিকের গঠন- যাকে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী মনে করা হয়। ছবি: অ্যাটলাসঅবসকিউরা.কম

জ্যাডোট এর মতে, মাছটিতে কিংবা মাছটি খাওয়ার ফলে মানুষের ভেতর যে 'ইকথিয়োআলিসিনোটক্সিজম' ঘটে তা সৃষ্টিকারী পদার্থগুলো শনাক্তের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি এখনো৷

কাজেই এই মাছটি খেলে কখন বিষক্রিয়া হবে আর কখন হবেনা- তা নিশ্চিত নয়৷ তবে বিশেষভাবে মাছটির মাথাতে এই বিষ বেশি থাকে। অন্য অংশগুলো সে তুলনায় অনেক কম হ্যালুসিনোজেনিক হয়৷ এছাড়া কোন মৌসুমে মাছটি ধরা হচ্ছে তার ওপরেও এটা নির্ভর করে, যেমন - ২০১২ সালের সেই রিপোর্টে বলা হচ্ছে শরৎকালে ধরা মাছে বিষের পরিমাণ ছিলো সবচেয়ে বেশি৷ আবার, ২০০৬ সালের এক রিপোর্টে দেখা গেছে বসন্তের শেষ কিংবা গ্রীষ্মে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি।

অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার যেটা, নিজে থেকে দুর্ঘটনাবশতও সারপা সালপা নিজের পাতে নেবার সম্ভাবনা আপনার নেই; কিন্তু ফ্রেঞ্চ রিভেইরায় যদি আপনি কোনো সামুদ্রিক মাছ অর্ডার করেন, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা হতে পারে এর সাথে৷ আর রান্নার পর অন্য মাছের ভিড়ে একে আলাদা করে চেনা যায় না। কিন্তু খাবারের পর যদি ৩৬ ঘণ্টা ধরে আপনার মনোজগত ভয়ের কালো পর্দায় ঢেকে থাকে, অন্তরাত্মা যদি অলীক জগতের অভিজ্ঞতায় কাঠ হয়ে যায়; তবে আর কেউ না জানুক, অন্তত জানবেন এর কারণটা আর কিছুই নয় - এর কারণ সারপা সালপা।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও  সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic