বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বাজারে মিলছে সবুজ রঙের মাল্টা, তবে ইদানিং বিক্রি বাড়ার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
এতদিন বাজারে বিদেশি হলুদ মাল্টার দাপট চললেও বেশি দাম এবং সংরক্ষণে রাসায়নিক ব্যবহারের আশঙ্কায় ক্রেতারা এখন সবুজ মাল্টার দিকে ঝুঁকছেন।
এই মাল্টা আসছে কোথা থেকে? ব্যবসায়ীরা বললেন, এটা দেশেই চাষ হচ্ছে।
দেশের মাটিতেই একদিকে যেমন ফলন বেশি হচ্ছে, সেইসঙ্গে অন্য মাল্টার তুলনায় দাম কম হওয়ায় ক্রেতারাও এই মাল্টা কিনছেন।
খাটো, ছড়ানো এবং বেশ ঝোঁপালো গাছগুলোতে বাতাবি লেবুর মতো থোকা থোকা ঝুলছে মাল্টা, গাড় সবুজ রঙের ফলগুলো পাকলেও রঙের কোনো পরিবর্তন ঘটছে না; টাঙ্গাইলের মধুপুর কিংবা খাগড়াছড়ির পাহাড়ি মাটিতে বারি-১ জাতের এই মাল্টার বাগান এখন চোখে পড়ছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, টাঙ্গাইলের মধুপুরের মতো তিন পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত এই মাল্টা চাষ হচ্ছে।
মধুপুরে প্রায় হাজারখানেক চাষি যুক্ত হয়েছেন সবুজ মাল্টা চাষে। তেমনই এক চাষি সানোয়ার হোসেন মূলত আনারস চাষ করলেও কয়েক বছর আগে কৃষি অফিসের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শে সবুজ মাল্টার চাষ শুরু করেন।
তিনি বলেন, “এ যাবত আমি চারবার ফসলও তুলেছি। বুঝেশুনে এই সবুজ মাল্টার চাষ করা গেলে আবাদ যেমন ভালো হয়, তেমনি দামও ভালো পাওয়া যায়।”
মধুপুরের মতো তিন পার্বত্য জেলার প্রায় হাজার খানেক চাষি যুক্ত হয়েছেন এই মাল্টা চাষে।
খেতে রসালো ও মিষ্টি এই ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা গেলে বিদেশি মাল্টার আমদানিনির্ভরতা কমার পাশাপাশি দেশের কৃষকদের লাভবান হওয়ার সুযোগও তৈরি হবে।
খাগড়াছড়ির কৃষি গবেষণা এলাকায় মাল্টার বাগান গড়ে তুলেছেন ঊষাতন চাকমা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গবেষণা কেন্দ্র থেকে দুইশ চারা নিয়ে মাল্টার বাগান করেছি। চারা লাগানোর তিন বছরের মাথায় ফলন আসা শুরু হয়েছে। প্রতিবছরই ভালো ফলন হচ্ছে।”
দামের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমার অধিকাংশ মাল্টা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বাজারে চলতি মৌসুমে বড় সাইজের মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।”
ঢাকার মিরপুর, মহাখালী, তেজগাঁও এবং কারওয়ানবাজার এলাকার বিভিন্ন ফলের দোকান ঘুরে দেখা যায়, বারি মাল্টা-১ বা সবুজ মাল্টা অনেক দোকানে থাকলেও হলুদ বিদেশি মাল্টার চেয়ে পরিমাণে কম।
আকারভেদে এসব মাল্টা প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় দোকানের চাইতে এসব মাল্টার সরবরাহ ও বিক্রি ভ্যান ও ফুটপাতেই বেশি হচ্ছে।
রাজধানীর ফার্মগেইটের ফুটপাতে পেঁপে, কমলার পাশাপাশি সবুজ মাল্টা বিক্রি করেন কবির হোসেন। তার ভাষ্য, “সবুজ মাল্টা সবাই চেনে না। তবে যারা চেনে তারা কেনে। কারণ, এটা দেশি, টাটকা।”
গত অগাস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে এই মাল্টা বেশি বিক্রি করেছেন বলে জানান কবির।
মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার পোশাক ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান দেশে প্রচলিত মাল্টায় রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে শঙ্কা থাকায় সবুজ মাল্টা কেনার কথা জানালেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিদেশ থেকে আসা মাল্টার মতো এত রসালো না হলেও, এই মাল্টার সবচেয়ে বড় গুণ এটি দেশীয়, ফরমালিনমুক্ত।
“বিদেশ থেকে নানা কেমিকেল দিয়ে মাল্টা আনা হয়। কিন্তু এই সবুজ মাল্টাগুলো নিরাপদ। তাই আমি প্রায়ই সবুজ মাল্টা নিই। আমার পরিবারের লোকজনও এই মাল্টা পছন্দ করে।”
কোন এলাকায় চাষ হচ্ছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, মধুপুর ও খাগড়াছড়ির মতো দেশের ৩০ জেলার ১২৩টি উপজেলায় এই মাল্টার চাষ হচ্ছে। মূলত লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের অধীনে এই মাল্টার চাষ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রকল্পের আওতায় এই বছরে অগাস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ১৩৪ হেক্টর জমিতে এই মাল্টার চাষ ও প্রদর্শনী করা হয়েছে। যেখানে মাল্টা উৎপাদিত হয়েছে ১৪ হাজার ২৩৩ মেট্রিক টন।
লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, “দেশের পতিত সব জমিকে আবাদের আওতায় আনা, সাইট্রাস জাতীয় ফল থেকে ভিটামিন সি-এর ঘাটতি পূরণ এবং মাল্টা/কমলা আমদানি করতে গিয়ে দেশ থেকে প্রতিবছর যে ডলার বিদেশে চলে যায়, তা সাশ্রয়ে আমরা এই লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি।”
দেশের প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে সবুজ মাল্টার সবচেয়ে ভালো জাত বারি মাল্টা-১ ও ২ চাষের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতি হেক্টরে ১০ টন সবুজ মাল্টা উৎপাদনের আশা করছেন তারা।
টাঙ্গাইলের মধুপুর, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলা, নেত্রকোণার দুর্গাপুর ও রাঙামাটির নানিয়ারচরসহ বারি মাল্টা চাষ হচ্ছে এমন ১০ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষকদের বিনামূল্যে বারি মাল্টা-১ এর চারা দিচ্ছে কৃষি অফিসগুলো। এ ছাড়া নিয়মিত ট্রেনিং ও যন্ত্রপাতিও পাচ্ছে কৃষকরা।
ফলন কেমন
সাধারণত বারি মাল্টা-১ এর গাছ লাগানোর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ফল আসে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চে ফুল আসে। এ মাল্টার মৌসুম মূলত অগাস্ট থেকে অক্টোবর মাস। সেপ্টেম্বরে এই মাল্টায় স্বাদ আসে।
একটি গাছ ১৫ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। প্রতি গাছে ১৫০ থেকে ২৫০টি পর্যন্ত ফল ধরে। গড়ে একটি গাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি ফল পাওয়া যায়।
দেশে বর্তমানে বারি মাল্টা-১ ও বারি মাল্টা-২ জাতের চাষই বেশি হচ্ছে। তবে ভিয়েতনামের ১২ মাস ফলনশীল জাত বাউ মাল্টা-৩ বাংলাদেশে চাষ উপযোগী করার জন্যেও কাজ চলছে।
লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক ফারুক বলেন, “কৃষকদের আমরা স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে ট্রেনিং দিচ্ছি। আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষক দল আছে। এই মাল্টা চাষে যেসব প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সার লাগে সেগুলো বাজারে পাওয়া যায়। আমরাও বিতরণ করি।”
বাজারে প্রভাব কেমন
হলুদ মাল্টার পাশাপাশি বাজারে সবুজ মাল্টার ক্রেতাও বেশ রয়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ী আবুল হাশেম, যিনি ঢাকার আগারগাঁওয়ে ভ্যানে করে সবুজ মাল্টা বিক্রি করে থাকেন।
হাশেমের ভাষ্য, “সবুজ মাল্টার ক্রেতা আছে। দাম কম ও দেখতে টাটকা হওয়ায় অনেকেই এটি কিনছেন।”
বেসরকারি চাকরিজীবী ফয়সাল হাসান বলেন, “এই মাল্টা বেশিদিন ঘরে রাখলে টেকে না, ভেতরটা শুকিয়ে যায়। তাই অল্প করে কিনতে হয়।”
মিরপুর ১০ নম্বরের ফলপট্টিতে বিক্রেতা শহিদুল্লাহকে দেখা যায় টুকরিতে করে সবুজ মাল্টা বিক্রি করতে। এই মাল্টা বিক্রি হলেও বাজার সবসময় ভালো যায় না বলে জানালেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শহিদুল্লাহ বলেন, “সবুজ মাল্টার বাজার সবসময় ভালো যায় না। মানুষ এখনও এটিকে চিনে উঠতে পারেনি।”
আরেক ব্যবসায়ীকে দোকানে সবুজ মাল্টা না রাখার কারণ জানতে চাইলে বলেন, “এই মাল্টার দাম কম। বেশিদিন থাকে না, শুকিয়ে যায়। ৫০ কেজি আনলে দিনে ১০ কেজি বিক্রি হয় বাকিটা পরের দিন আর টাটকা থাকে না।”
কারওয়ানবাজারের দুই ফল ব্যবসায়ীও সবুজ মাল্টা বিক্রিতে অনাগ্রহের ব্যাপারে একই কথা জানান।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মনোভাব প্রসঙ্গে লেবুজাতীয় ফসলের সম্প্রসারণ, ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, “এই ফল কখন গাছ থেকে তুলতে হবে, তা ভালোভাবে বুঝতে পারছেন না আমাদের কৃষকেরা। ফলে এই ঘটনা ঘটছে।
“অনেক সময় তারা অপরিপক্ব ফল তুলছেন, আবার কেউ কেউ অনেক অপরিপক্ব ফল তুলে ফেলছেন। ফলে এর মিষ্টতা ও রসালো ভাব কম হচ্ছে।”
বারি মাল্টা-১ এর ফল কেমন হবে, সেটি জমিতে পানি প্রবাহের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে বলে জানান তিনি।
তবে আশার কথা জানিয়ে ফারুক বলেন, “মাল্টা আমাদের দেশে হবে এবং তা বাজারে আসবে এটি বেশ বড় একটি ব্যাপার। আমাদের এই প্রকল্পের প্রভাব দৃশ্যমান।
“এই প্রকল্পে আরও গবেষণা বাড়িয়ে কীভাবে দেশীয় এই মাল্টা সবার কাছে জনপ্রিয় করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”