সফদার হাশমি: জীবন দিয়ে বলতে শিখিয়েছেন 'হাল্লা বোল'


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: January 08, 2023 13:22:44


সফদার হাশমি (১৯৫৪-৮৯),                                      ছবি: অভীক কুমার মৈত্র

থিয়েটার শুধু মঞ্চে সুসজ্জিত অবস্থায় হবেনা, বরং হবে একেবারে মানুষের সামনে। গণমানুষের ভাষায় তুলে ধরা হবে তাদের সংকটকে। তাদের সচেতন করার মাধ্যম হবে নায়ক। এমনটাই ভাবতেন সফদার হাশমি।

১৯৭৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই গড়ে তোলেন জন নাট্যমঞ্চ। সংক্ষেপে দলটির নাম ছিলো 'জনম।' ভারতীয় গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে তারা এই দল গড়েন।

সে সময়ে নির্বাচনে অনিয়মের প্রতিবাদ হিসেবে তিনি পথনাটক  তৈরি করেন। নাম ' কুরসি, কুরসি, কুরসি।' কুরসি অর্থ আসন। নাটকে এক রাজা থাকেন। আর থাকে তার সিংহাসন। রাজা কোথাও যেতে চাইলে সিংহাসনও তার পেছন পেছন যায়। অন্য কাউকে এটা দিয়ে দেয়া যায়না।

নয়াদিল্লীর বোট ক্লাব লনে এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এই নাটক। এর ফলে দেশজুড়ে পরিচিতি পায় 'জনম।'

১৯৭৫ এ জরুরি অবস্থা জারির আগপর্যন্ত জনমের হয়ে সফদার তার পথনাটক জারি রাখেন। এরপর কিছুদিনের জন্য তার স্নাতকের বিষয় ইংরেজি সাহিত্যে ফিরে যান। শিক্ষকতা করেন গেরওয়াল, কাশ্মীর ও দিল্লীর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

নাটকই ছিলো সফদারের প্রাণ,  ছবি: ক্রেডিবল হিস্ট্রি

১৯৭৭ পরবর্তী সময়ে আবারো নাটকে ফেরেন। ১৯৭৮ এর ২০ নভেম্বর ২ লাখ কৃষকের উপস্থিতিতে 'মেশিন' নামের পথনাটকটি করেন।কীভাবে আর দশটি যন্ত্রের মতো জলজ্যান্ত কৃষকেরাও পুঁজিপতিদের কাছে যন্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, তা তিনি তুলে আনেন কৃষক-শ্রমিকের ভাষায়।  এরপর ক্ষুদ্র কৃষিজীবীদের দুর্দশা নিয়ে 'গাঁও সে শাহার তাক',  সামন্তপ্রভুদের নিয়ে 'হাতিয়ারে ও অপহরণ বাইচারে কে', বেকারত্ব নিয়ে 'তিন ক্রোর', নারী নিপীড়ন নিয়ে 'আওরত' ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে 'ডিটিসি কি ধান্দাই' নাটকগুলো করেন।

১৯৭৯ এর পর কিছুদিন প্রেস ট্রাস্ট অভ ইন্ডিয়া (পিটিআই) ও  দি ইকোনমিক টাইমস- এ সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট সরকারের 'প্রেস ইনফরমেশন অফিসার' হিসেবে দিল্লীতে কর্মরত ছিলেন।

কিন্তু বাঁধাধরা জীবন তার ভালো লাগছিলো না । নিজে সিপিআই(এম) সমর্থক হলেও সরকারি চাকরি তার ভালো লাগেনি। এরপর ১৯৮৪ তে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি রাজনীতি ও নাটকে মনপ্রাণ সঁপে দেন সফদার।

১৯৮৩ তে প্রকাশিত তার 'রাইট টু পারফর্ম' বইয়ে লিখেছেন, "ব্যাপার এটা না যে, নাটকটা কোথায় হচ্ছে (আর পথনাটক শিল্পকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার একটা উপায়মাত্র) , কিন্তু মূল ব্যাপার হলো শিল্পের বুর্জোয়া ব্যক্তিতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও গণমানুষের সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার বৈপরীত্য- যা সুনির্দিষ্ট ও মীমাংসার উর্ধ্বে।"

সফদার আশির দশকে ম্যাক্সিম গোর্কির 'এনিমিস' অবলম্বনে প্রসেনিয়াম ধাঁচের নাটক আনেন (১৯৮৩)।  ১৯৮৮ সালে হাবিব তানভীরের সাথে যৌথভাবে লেখেন আরেকটি প্রসেনিয়াম নাট্য- 'মোতারেম কা সত্যগ্রহ।'

১৯৮৩ তে পথনাটকে সফদার হাশমি, ছবি: ট্রিবিউন ইন্ডিয়া

১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি সফদার তাদের বিখ্যাত নাটক 'হাল্লা বোল' (রেইজ ইয়োর ভয়েস') নিয়ে যান দিল্লী থেকে ১৭ কি.মি দূরে গাজিয়াবাদে। নাটক চলছে, পাশে হাজার হাজার মানুষ। এর ভেতরই অস্ত্রধারীদের আক্রমণ! গুরুতর আহত সফদার পরদিন হাসপাতালে মারা যান।

এরপর পুরো ভারত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শাবানা আজমি তথ্য মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে হওয়া চলচ্চিত্র উৎসবে সবার সামনে ঘটনার উল্লেখ করে বিচার চান। পূর্ণেন্দু পত্রী লেখেন 'নতুন কবিতা: সফদর হাশমি।'

তবে সবচেয়ে সাহস এক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন তার স্ত্রী মলয়শ্রী হাশমি। তিনি ৪ জানুয়ারি হামলার জায়গাটিতেই 'হাল্লা বোল' নাটকটি করেছিলেন।

সফদারের মৃত্যুর পর কাশ্মীর গেটে তার জানাযায় নয় মাইল রাস্তা জুড়ে মানুষের ঢল নেমেছিলো।তবে সে সময়ে গ্রেফতার করা হয়নি কাউকেই। ঘটনার কোনো ফলপ্রসূ তদন্তের চেষ্টাও দৃশ্যমান হয়নি। ২০১৪ সালে ঘটনার ২৫ বছর পর মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে গ্রেফতার করা হয় কংগ্রেস নেতা মুকেশ  শর্মাকে। 

সফদারের মৃত্যু তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করলেও গণমানুষের জন্য শিল্পকে নিয়োজিত করার এক চিরায়ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছে।  সন্ত্রাসী হামলায় তাকে হত্যার পরও 'হাল্লা বোল' কে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। যুগ যুগ ধরে মানুষকে গলা উঁচু করে তাদের কথা বলার জন্য সাহস দিয়ে যাচ্ছে। যেখানেই কণ্ঠরোধের চেষ্টা, সেখানেই মনে পড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে গণজমায়েতের সামনে সফদার হাশমি বলছেন- 'হাল্লা বোল।'

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like