Loading...
The Financial Express

শৈশব কাটছে টিভি-ফোনে, স্ক্রিন আসক্তি কাটবে কীসে?

| Updated: October 16, 2022 10:32:34


অনেক মা-ই বলে থাকেন, খাওয়ার সময় টিভি ছেড়ে না দিলে কিংবা মোবাইল হাতে না দিলে বাচ্চা খেতে চায় না। অনেক মা-ই বলে থাকেন, খাওয়ার সময় টিভি ছেড়ে না দিলে কিংবা মোবাইল হাতে না দিলে বাচ্চা খেতে চায় না।

“যখনই খাবার সময় হবে, বাচ্চারা সেটা খাবে টিভি দেখতে দেখতে। টিভি বন্ধ করে দিলাম তো ফোন দেখতে থাকবে। ফোনটা নিয়ে নিলাম তো আবার টিভি। ওরা ফোন বা টিভি ছাড়া থাকতেই পারছে না।” খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

শিশু-কিশোরদের স্মার্টফোন আসক্তি, আরও বিশদে বলতে গেলে স্ক্রিন আসক্তি নিয়ে অভিভাবকদের কীভাবে হিশশিম খেতে হচ্ছে, সে কথা বলছিলেন ঢাকার পল্লবী এলাকার বাসিন্দা নুসরাত আহ‌মেদ।

তার মেয়ের বয়স ১২ বছর, ছেলের চলছে ৯। মেয়ের নিজের ফোন থাকলেও ছোটো ছেলে মায়ের ফোন নিয়েই মগ্ন থাকে দিনের বড় একটা সময়; হয় কোনো গেইমে, নয়ত ইউটিউবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে নুসরাত জানালেন, ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে এখনি ফোন কিনে দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। ফোনটা সে পেয়েছে বড় চাচার কাছ থেকে উপহার হিসেবে।

”ও অবশ্য পড়ালেখা ঠিক রেখে ফোন নিয়ে বসে, নির্দিষ্ট সময় দেখে। তবুও মনে হয় ফোনে একটু বেশি সময় দেয়। আর ছোটটা আমার ফোন নিয়ে বসে থাকে সব সময়।”

শিশু-কিশোরদের হাতে কোন বয়সে ফোন দেওয়া উচিৎ?  স্ক্রিন টাইম কতক্ষণ হলে সেটা শিশু-কিশোরদের ক্ষতির কারণ হবে না?

গত জুলাই মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে নিজের ব্যবহারের জন্য মোবাইল ফোন রয়েছে ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশের; যা ওই বয়সী শিশুর মোট সংখ্যার অর্ধেকের বেশি। একই বয়স শ্রেণির শিশুদের মধ্যে ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ আবার ইন্টারনেটও ব্যবহার করে।   

আজকের যুগে এটা খুব বেশি? যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা অফকমের এক জরিপে বলছে, সে দেশের অধিকাংশ শিশু ১১ বছর বয়সেই নিজের স্মার্টফোন হাতে পায়। নয় বছর বয়সীদের ৪৪ শতাংশের নিজের ফোন রয়েছে, এবং ১১ বছর হতে হতে তা বেড়ে ৯১ শতাংশে পৌঁছায়।

যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা কিছুটা কম। সেখানে নয় থেকে ১১ বছরের শিশুদের ৩৭ শতাংশের নিজের স্মার্টফোন রয়েছে।

১৯টি দেশ নিয়ে ইউরোপীয় এক গবেষণার বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, নয় থেকে ১৬ বছর বয়সী ৮০ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইনে আসার জন্য; তারা বলতে গেলে প্রতিদিনই অনলাইনে থাকে।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা বোঝাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইরভিনে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক ক্যানডিস অডজারস বিবিসিকে বলেন,”আমরা বুড়ো হওয়ার আগেই ৯০ শতাংশ শিশুর হাতে ফোন দেখা যাবে।”

শিশুরা কোন বয়সে হাতে ডিজিটাল ডিভাইস আর কতক্ষণ স্ক্রিন টাইম পেতে পারে– তার একটি মানদণ্ড দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

সেখানে বলা হয়েছে, এক বছরের কম বয়সী শিশুর হাতে ডিভাইস যাওয়া একদমই উচিত নয়। দুই বছর বয়সী শিশুর জন্য এক ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম নয়, এর থেকে কমানো গেলে ভালো। আর তিন থেকে চার বছর বয়সী শিশুরা এক ঘণ্টার বেশি যেন ডিভাইস ব্যবহার না করে।

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তাদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে চান লীনা ফেরদৌস। সেভাবেই প্রায় ১২ বছর ধরে নিজের প্রিস্কুল ও ডে কেয়ার চালাচ্ছেন তিনি।  

ঢাকার উত্তরায় তার কিডজ লিডজ প্রিস্কুল ও ডে কেয়ার ইনস্টিটিউটে ১৮ মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রিস্কুল সুবিধা আছে; ওই বয়সী শিশুরা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন-চার ঘণ্টা সেখানেই কাটাতে পারে।

আর ডে কেয়ারে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের রাখা হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েরা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা মত এসে রেখে যান, পরে নিয়ে যান । শিশুরা যতক্ষণ সেখানে থাকছে, তাদের ডিভাইস থেকে মনোযোগ সরিয়ে নানা মজার কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে কিডজ লিডজ কর্তৃপক্ষ। 

কিডজ লিডজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লীনা বলেন, ”যে মায়েরা ডিভাইস চালু করে বাচ্চাদের খাওয়ানো অভ্যাস করেছে, আমাদের এখানে ওই বাচ্চারা এলে কিছুদিন টিভি ছেড়ে দেখানো হয়। মানে মায়ের স্টাইলটা রাখা হয়। ১৫ থেকে ২০ মিনিট ছড়া-শিশুতোষ অ্যাকটিভিটিজ নিয়ে প্রোগ্রাম চলে তখন। এরপর ধীরে ধীরে টিভির অভ্যাস কমিয়ে এক পর্যায়ে সেটা বাদ দেওয়া হয়।”

সন্তানের স্ক্রিন টাইম সীমিত রাখা নিয়ে বেশ সচেতন মাবরুকা তোয়াহা। ব্রিটিশ কাউন্সিলে কর্মরত ইংরেজির এই শিক্ষক পরিবার নিয়ে থাকছেন সৌদি আরবে।

আট বছর বয়সী ছেলের একদিনের স্ক্রিন টাইম নিয়ে তিনি ধারণা দিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে। 

মাবরুকা বলেন, “আমি যখন সৌদি আরবে মুভ করি, বাসায় টিভি নিইনি।প্যানডেমিকের আগ পর্যন্ত আমার বাসায় নেটফ্লিক্স বা কোনো ইন্টারনেট টিভি ছিল না।

“ওই সময় একটু বেশি দেখার সুযোগ ছিল। তো যখনই দেখি, আমরা ঠিক করে নিই কতক্ষণ দেখব। যেমন এখন সকালে ওর স্ক্রিন টাইম নেই; যেহেতু স্কুল আছে। স্কুল থেকে ফিরে ও ১৫ মিনিট পাবে।”

“... স্কুলের কাজ যেমন ক্লাসটেস্ট বা হাতের লেখা ভালো করেছে, তখন সে পাঁচ মিনিট বাড়তি পায়। সন্ধ্যাবেলা হাতের কাজ শেষ করে ফেললে মোটামুটি সে ১৫ থেকে ২০ মিনিট পায়। ওই সময়টা বেশি না করতে পারি না; তাই আমরা একটু ফ্লেক্সিবল থাকি। কিন্তু কখনোই আধা ঘণ্টার বেশি দিই না।”

স্ক্রিন আসক্তি কমানো কেন জরুরি

অনেক মা-ই বলে থাকেন, খাওয়ার সময় টিভি ছেড়ে না দিলে কিংবা মোবাইল হাতে না দিলে বাচ্চা খেতে চায় না। কিডজ লিডজের পরিচালক লীনা ফেরদৌস বলছেন, টিভি ছেড়ে রেখে বাচ্চাকে খাওয়ানো একদমই ঠিক না।

“তখন হয় কি, বাচ্চা স্বাদ বোঝে না। ও চিনি খাচ্ছে না লবণ খাচ্ছে, মিষ্টির স্বাদ কেমন, মাছের স্বাদ, সবজির স্বাদ কেমন... বাচ্চা তো ওর মনোযোগ অন্যখানে দিয়ে রেখেছে।”

নিজের ডে কেয়ার পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে লিনা বলছেন, মহামারীর বছরে জন্মানো যে শিশুরা তার প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, তাদের অনেকেরই কথা বলা শিখতে দেরি হওয়ার (স্পিচ ডিলে) সমস্যা দেখা যাচ্ছে।

“যে বাচ্চারা আসছে দুই বছর বয়সের, তাদের বেশির ভাগেরই এক সমস্যা। বাচ্চা কথা বলছে না। এর কারণ হতে পারে ওই সময় সময় বাবা-মা অনলাইনে কাজে ব্যস্ত থেকেছেন।”

ঢাকা শিশু হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. লুনা পারভীনও বললেন, স্ক্রিন আসক্তি থেকে শিশুর এমন সমস্যা হতে পারে। তবে দুবছর পর্যন্ত তারা সাধারণত ‘স্পিচ ডিলে’ বলেন না।

“দুই-আড়াইয়ের পরে যদি দেখি অর্থপূর্ণ শব্দ বলতে পারছে না, তাহলে স্পিচ ডিলে হিসেবে ধরি। স্ক্রিন টাইমে থাকা মানে বাচ্চা শুধু দেখছে, সে কথা বলছে না। বাচ্চাকে অবশ্যই শোনার সঙ্গে সেভাবে কথা তৈরি করে বলতে হবে। এটা টু-ওয়ে কমিউনিকেশন হবে।”

স্ক্রিন টাইমের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও রয়েছে জানিয়ে ’শিশুর যত্নে মায়ের জিজ্ঞাসা’ বইয়ের এই লেখক বলেন, “এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। তাতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আর ভায়োলেন্স রয়েছে এমন কনটেন্ট দেখলে বাচ্চাদের মনের নরম-কোমল ভাবটা কমে যেতে পারে।”

মহামারীতে অনলাইন ক্লাসে টানা ইয়ারফোন লাগিয়ে বসে থাকতে সন্তানরা বিরক্তি হত বলে জানালেন পল্লবীর নুসরাত আহ‌মেদ। তার মনে হয়েছে, ফোন ব্যবহারে সন্তানদের স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি সামাজিক মেলামেশার দক্ষতাকেও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

 “এতক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় ওদের চোখের উপরও প্রভাব পড়ছে। মাথাব্যথা করে ওদের। কোথাও বেড়াতে গেলে আগে বলে ‘ফোন দাও’। আমাদের সময় যেমন বাসায় মেহমান এলে আমরা সামনে যেতাম, আমি সেটা আমার বাচ্চাদের বেলাতেও চেষ্টা করি। তবু যেন আমার মনে হয় সারাক্ষণ ফোন নিয়ে থাকাতে থাকতে ওরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়।”

স্ক্রিন আসক্তি কখনও কখনও রোগ হিসেবেও গণ্য হতে পারে বলে জানালেন ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট ও হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার।

রোগ ও রোগীর বিশ্লেষণে ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডারস বা ডিএসএম প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর পঞ্চম সংস্করণ বা ডিএসএম-ফাইভ এ বছর মার্চে প্রকাশ করেছে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন। এবার মানসিক রোগ হিসেবে সেখানে ‘ইন্টারনেট গেইমিং ডিসঅর্ডার’ যোগ করা হয়েছে। 

এই আসক্তির ধরনটা ব্যাখ্যা করে মেখলা সরকার বলেন, ”ইচ্ছাকৃত বা বাধ্যগত স্ক্রিন ব্যবহার যদি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার বাড়তে থাকে...  শিশু-কিশোর বা বড়রাও যদি নিজের যত্ন এবং কাজ, সামাজিকতা, সম্পর্ক থেকে মনোযোগ সরিয়ে স্ক্রিনেই থাকে, এরকম পর্যায়কে বলে আসক্তি।”

বিদেশি গবেষণা কী বলছে?

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজের এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিস্ট অ্যামি অরবেন ও তার সহকর্মীরা গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেন, সোশাল মিডিয়ার ব্যবহারে জীবনের পরবর্তী ধাপে হতাশা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে; বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিতে।

এই গবেষক দলটি ১০ থেকে ২১ বছর বয়সী ১৭ হাজার শিশু-কিশোরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। তাদের ভাষ্য, ১১ থেকে ১৩ বছরের মেয়ে ও ১৪ থেকে ১৫ বছরের ছেলেদের বেলায় যত বেশি সোশাল মিডিয়ায় সময় কাটানো বেড়েছে, পরের বছর খানেকের মধ্যে তাদের মধ্যে হতাশা দেখা গেছে।

এর বিপরীত দিকটিও সত্য হতে দেখা গেছে এ গবেষণায়। অর্থ্যাৎ ওই একই বয়সীরা সোশাল মিডিয়াতে কম সময় দেওয়ার ফলে জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের মাত্রা বেশি ছিল।  

অরবেন বলেন, “বিকশিত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়টা এই টিন বয়স। এই বয়সে সবকিছুকে সূক্ষ্ণভাবে দেখার আগ্রহ জাগে। মানুষ এসময় তাকে দেখে কী ভাবছে তা জানতে ইচ্ছে হয়। আর সোশাল মিডিয়া যেভাবে সাজানো হয়, অর্থ্যাৎ এখানে যেভাবে যোগাযোগ, প্রতিক্রিয়া দেখানো আর বাটনে ক্লিক করতে হয়, তা অনেক সময়ই মানসিক চাপ ফেলতে পারে।”

‘ভালো কিছুও’ হতে পারে

সন্তানদের স্ক্রিন অভ্যস্ততা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও দুই সন্তানের মা নুসরাত আহমেদ মনে করেন, ভালো কিছুও শেখা সম্ভব।

“আমার বড় মেয়ে আগে থেকেই আঁকতে পারত। প্যানডেমিকের সময় ও ইন্টারনেট থেকে দেখে অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকেছে। এমনকি আমি বলা বা শেখানোর আগেই আরও অনেক কিছু আমার মেয়ে ফোনে ইন্টারনেট থেকেই শিখে গেছে। ইউটিউব থেকে শিখেছে।”

বিবিসি লিখেছে, বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বেলায় ফোন সাথে থাকা যেন প্রাণ ফিরে পাওয়ার মত। ফোন ও অনলাইন থেকে বিশেষ সুবিধা, নেটওয়ার্কিং ও স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য জানতে পারে তারা।

১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের ওপর জরিপ চালিয়ে ডেনমার্কের গবেষকরা বলেছেন, সঙ্গে স্মার্টফোন থাকার কারণে তারা বরং স্বাধীনভাবে বাইরে সময় কাটাতে পারে। বাবা-মাও সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেকখানি নিশ্চিত বোধ করেন।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার অধ্যাপক অডজারস বলেন, “অনেক সময় বাবা-মা নিজে থেকেই সন্তানকে ফোন কিনে দিতে আগ্রহী হন। কারণ এতে করে তারা সারাদিন সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সন্তানকে কখন আনতে যেতে হবে সেটা জানাও সহজ হয়।”

আর অস্ট্রিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার কমিউনিকেশন বিভাগের গবেষক আনজা স্টেভিকের মতে, শিশু-কিশোরদের হাতে ফোন দেওয়া মানে তাদের দায়িত্বশীল হতে পথ দেখানো।

কেন এই আসক্তি?

এক ইউরোপীয় জরিপ বলছে, নবজাতক থেকে আট বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্তি তৈরি হয় বাড়িতে বাবা-মাকে দেখে।

বাংলাদেশেও অভিভাবকদের এই ’ভুল’ থেকে শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি দেখা দিচ্ছে বলে মনে করছেন প্রবাসে থাকা আট বছরের সন্তানের মা মাবরুকা তোয়াহা।

তবে পল্লবীর বাসিন্দা নুসরাত আহমেদ বলছেন, মহামারীর ঘরবন্দি দিনেই তার দুই সন্তানের টিভি দেখা ও ফোন চালানোর ঝোঁক বেড়ে গেছে।

“তখন সারা দিনরাত ওরা বাইরে যেতে পারত না, খেলতে যেতে পারত না, কারো সাথে মিশতে পারত না। অ্যাপ, গ্যাজেট, মোবাইল বা টিভি নিয়েই থাকত।”

ঢাকার অনেক অভিভাবকের মত নুসরাতও বাচ্চাদের একা বাইরে ছাড়তে স্বস্তিবোধ করেন না। এটাও ডিভাইস ব্যবহারে তাদের ছাড় দেওয়ার একটি কারণ।

“আগে আমরা বিকেল হলে বাইরে যেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে মিশতাম। কিন্তু এদের বেলায় তো সেই সময়টা নাই। সেই জায়গাও নাই। সেই নিরাপত্তাটুকুও নাই।” 

নুসরাত আহমেদের এই ভাবনায় সায় জানালেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লুনা পারভীনও। পাশাপাশি একান্নবর্তী পরিবার না থাকা এবং কর্মজীবী পরিবারের সংখ্যা বাড়তে থাকাও শিশু-কিশোরদের স্ক্রিনমুখী করছে বলে তিনি মনে করেন।

করণীয় কী?

বিবিসি লিখেছে, শিশুদের স্ক্রিন টাইম নিয়ে এই উদ্বেগ সারা বিশ্বেই বাড়ছে। তবে সন্তানকে কোনো শর্ত দেওয়ার আগে অভিভাবদের বরং নিজের ফোন চালানোর অভ্যাসের দিকে ভালো করে তাকানো দরকার।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে প্যারেন্টিং ফর এ ডিজিটাল ফিউচার বইয়ের লেখক যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অফ ইকনোমিকসের সোশাল সাইকোলজির অধ্যাপক সোনিয়া লিভিংস্টোন বলেন, “তাদেরকে ফোন ধরতে মানা করা হবে, কিন্তু বাবা-মা নিজেই খাওয়া-ঘুমের সময় তা করে যাবে–এমন দুমুখো আচরণ শিশুরা অপছন্দই করে।”

এসব কারণে সন্তানের স্ক্রিন টাইমের সঙ্গে বাড়িতে নিজের ফোন ও টিভি দেখার সময় মিলিয়ে নিয়ে চলেন প্রবাসী মা মাবরুকা তোয়াহা। আর নিজের ব্যক্তিগত স্ক্রিন টাইম তিনি সন্তানের ঘুমের সময়ে রাখার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি আট বছর বয়সী সন্তানকে নানা চর্চার মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চলে তার।

“আমরা সাপ্তাহিক ছুটিতে বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার একটা সিনেমা দেখি। আমার বই পড়ার অভ্যাস আছে। আমার ছেলেও বেশ পড়ে। সৌদিতে বই কিনে পড়া বেশ খরচ সাপেক্ষ। এখানে বুক স্টোর আছে. আমরা যাই। তিন-চার ঘণ্টা বই পড়ি।

“আমরা রেডিও বা অডিও শুনি প্রচুর। ঘুমানোর আগে আমরা পাঁচ থেকে দশ মিনিট, কোনো কোনো দিন পনের মিনিট রেডিও শুনি; বাচ্চাদের অনুষ্ঠান বা গল্প।

“এখানে প্রচুর গরম। বাগান করতে কষ্ট হয়। তবু আমাদের ছোট্ট একটা বাগান আছে। পালং শাক, লাল শাক, পুদিনা পাতা, বেগুন গাছ। খুব খেতে পারি তা না। তবে ছেলের একটা অ্যাকটিভিটি থাকে যে গাছে পানি দিতে হবে।... ছুটির দিনে নাস্তা বানানো, ঘর গোছানো, টয়লেট ক্লিন করা এমন লাইফ স্কিলগুলোও শেখানো জরুরি বাচ্চাকে।” 

ফোন বা কমপিউটার ইন্টারনেটে যুক্ত থাকলে বয়স অনুযায়ী দেখার অনুপযোগী অনেক কিছুই শিশুদের সামনে আসতে পারে। আর তাই কাজেকর্মের মাঝেও সন্তানদের পাশে বসে বিষয়টি নজরে রাখার চেষ্টা করেন নুসরাত আহমেদ।

তিনি বলেন, ”বাড়িতে টিভির সঙ্গে পিসির কানেকশন দেওয়া আছে। তাতে করে ছোট ছেলেটা পিসিতে বসলে আমি টিভি স্ক্রিনে দেখতে পাই। ফোনে বসলে কাজের মাঝেও পাশে গিয়ে বসি অনেক সময়।ওরা ফাইভ মিনিটস ক্রাফটস দেখে; ছেলেটা ফোনে গেইম খেলে বেশি। 

“বাচ্চাদের সঙ্গে আমি আলাপ করি; তাদের বলেছি, এখানে ভালো আছে খারাপও আছে। ভালোটা নিলে ভালো কিছু শিখবে।”

টিভি চালিয়ে সন্তানকে খাওয়ানোর অভ্যাস এড়াতে ডা. লুনা পারভীনের পরামর্শ, খাওয়ার সময় বরং গান শোনানো যায়।

“আসলে বাচ্চার খিদে লাগতে হবে। খাওয়ার চাহিদা থাকতে হবে। এক বা দুবছর বয়স হলে আলাদা চেয়ারে বড়দের সাথে বসিয়ে দিলে বড়দের খেতে দেখে, চিবুতে দেখে সেও আগ্রহ করে খেতে শিখবে।”

সব রকম চেষ্টার পরও মাত্রাতিরিক্ত স্ক্রিন আসক্তি দেখা গেলে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে বলে জানালেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার।  

তিনি বলেন, ”যদি চিকিৎসক কারো বেলায় এই ডিসঅর্ডার দেখেন, তবে মাদকাসক্ত ব্যক্তির যেমন চিকিৎসা হয়, অনেকটা তেমনভাবেই চিকিৎসা করতে হয়।

“রোগী যদি বেশি রিঅ্যাক্ট করে, ভাঙচুর করে, পরিবার হয়ত আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, সেসব ক্ষেত্রে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়।”

অভিভাবকদের জন্য তার পরামর্শ, ”শিশুর মোবাইল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও তার যে বয়স অনুসারে মানসিক চাহিদা রয়েছে, বাবা-মাকে সেসব অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ও পূরণ করতে হবে।

”বয়স হিসেবে দায়িত্ব বোধ বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে। তাহলেই স্ক্রিন আসক্তি থেকে সন্তানকে মুক্ত রাখায় সফলতা পাওয়া যাবে।”

Share if you like

Filter By Topic