Loading...
The Financial Express

শিশু সাহিত্যের স্বপ্ন কারিগর: একজন আলী ইমাম

| Updated: November 22, 2022 19:46:12


শিশু সাহিত্যের স্বপ্ন কারিগর: একজন আলী ইমাম

কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য লেখালেখি করতে গেলে লেখককেও তাদের মতো কল্পনার জগতে ডানা মেলে উড়তে জানতে হয়। শিশু সাহিত্যিক আলী ইমাম একথা জানতেন। তাই নিজেকেও তিনি সরল ধাঁচে আনন্দময় করে রাখতেন। ভালো থাকার চাবিকাঠি মেনে চলতেন দৈনন্দিন জীবনে চর্চিত ইতিবাচকতাকে।

বছরের শেষ দিনে তার জন্মদিন ছিল– যদিও এই দিনটিকে খুব একটা বিশেষ মনে করতেন না তিনি, মধ্যবিত্ত বেড়ে ওঠা জীবনের পরম্পরা হিসেবেই হয়তো। তবে সেই দিন শিশুদের জন্য কলম ওঠানো এই ব্যক্তিটি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে প্রায় বছরই পোশাক বা খাবার-দাবার বিতরণ করতেন। আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া, মূলত এতেই ছিল তার আনন্দ।

উপহার হিসেবে নিজের জন্য পছন্দ ছিল ফুল, আর ফুলের মতো শিশুদের জন্য লেখালেখি করেই তিনি তার জীবন কাটিয়ে দিলেন। তার লেখা বইয়ের মোট সংখ্যা ছ’শো ছাড়িয়েছিল। এর মধ্যে গল্প-ছড়া, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, নাটক, প্রবন্ধ, জীবনী, অনুবাদ– কিছুই তেমন একটা বাদ যায়নি। সবগুলো শাখাতেই তিনি পারদর্শিতার সাথে নিজের ছাপ ছেড়ে গেছেন।

কিশোরকাল থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তিনি। তার লেখালেখির জগতে আসা যে বইটি পড়ে, সেটিও বাংলা শিশু সাহিত্যের অন্যতম আকর– অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বুড়ো আংলা’। 

১৯৭৬ সালে ২৬ বছর বয়সে আলী ইমামের প্রথম গল্পের বই ‘দ্বীপের নাম মধুবুনিয়া’ প্রকাশ পায়। এর পর থেকে খুব একটা থেমে থাকেননি তিনি ও তার কলম। একের পর এক রচনায় সমৃদ্ধ করেছেন শিশুতোষ সাহিত্যের শাখাকে। অন্যসব মাধ্যমকে ছাড়িয়ে বই তার কাছে ছিল সবচাইতে মহান, কেননা তার মতে, বই মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে। আর স্বপ্নালু শিশুদের স্বপ্নের পথে যাত্রা করার জন্য বইকেই তিনি সর্বোচ্চ সহায়ক মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। বই নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া এই মানুষটি বইয়ের কোনো বিকল্প দেখতেন না। 

বিশ্ব রূপকথার আকর থেকে তিনি বাংলাভাষী শিশু-কিশোরের জন্য হ্যান্স অ্যান্ডারসন ক্রিশ্চিয়ানের লেখা অনুবাদ করেছেন। তবে গল্প-ছড়ায় শুধু শিশুদের মন মাতানোই নয়, আলী ইমামের লেখা বিজ্ঞান-ইতিহাসের বইগুলোতে মিলবে জ্ঞানের মুক্তোরও দেখা। সহজ ভাষায় লিখে রাখা আপাত জটিল বিষয়গুলো শিশুমনে আগ্রহ সৃষ্টি করে। তার লেখা এমন কিছু বই হচ্ছে ‘মিশর সভ্যতা’, ‘মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কাহিনী’, ‘প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজে’ ইত্যাদি। দেশ ও জাতির ঐতিহ্যের সাথে যাতে শিশুকাল থেকেই পরিচিত হওয়া যায়, সেজন্য আলী ইমামের কলম তুলে আনে ‘শিশুদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’-এর মতো বই। 

বিজ্ঞান যে একঘেয়ে নয় এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার চাইলেই উপভোগ করা যায়, সেসব বুদ্ধিও তিনি দেন ছোটদের বিজ্ঞান প্রজেক্ট তৈরির বইতে। শুধু তত্ত্বকথা আর লিখিত ফর্মুলা পড়ে নয়, নিজের মতো করে যাতে ছোটরা বিজ্ঞানকে আবিষ্কার করতে পারে– সে উদ্দেশ্যে তিনি একাধিক বই লিখেছেন। আনন্দমূলক শিক্ষার পথ প্রসারিত করা ছিল তার লেখালেখির অন্যতম মূলকথা। 

২০০৩ সালে বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি অর্জন করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। লেখালেখির পাশাপাশি গণমাধ্যমেও জীবনের বড় একটি কাটিয়েছেন তিনি। বেতার ও টেলিভিশনে তার পরিচালিত ও উপস্থাপিত অধিকাংশ অনুষ্ঠান ছিল শিক্ষামূলক। জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর মাঝে বিটিভিতে তার উপস্থাপিত ‘হ্যালো, আপনাকে বলছি’ আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তার প্রযোজনায় প্রামাণ্য শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। 

পাখি নিয়ে বিশটিরও বেশি লেখা বইয়ের এই লেখককে মানবকণ্ঠ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, পাখির মতো ডানা পেলে কী করবেন তিনি। তিনি ভুটানে যেতে চেয়েছিলেন। প্রজাপতির ডানা মেলার শব্দ শুনতে তিনি পাখি হয়ে ডানা মেলতে চেয়েছিলেন। টাইম মেশিনে চড়ে তার একবার সক্রেটিস যুগের গ্রিস ঘুরে আসার শখ ছিল। হয়তোবা জুটে যেতেন সক্রেটিসের শিষ্যদের দলে। 

কিন্তু আলী ইমাম গ্রিসে জন্মাননি, সক্রেটিসের শিষ্যও হননি। তবে তিনি ইচ্ছে আর কল্পনা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন গ্রিস থেকে বহুদূরে, সেই সময়ের বহু বছর পরের বাংলাদেশে বসে। ডানা মেলার জন্য যে আসলেই আকাশে উড়ে যেতে হয় না, কলমের হাল ধরে চাষ করা যায় কল্পনার ফসল– তার প্রতিটি বই বা সাক্ষাৎকারে আলী ইমাম সে কথাই বলে গেছেন বিভিন্ন সময়ে, একই স্বরে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্ম নিলেও জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে পুরান ঢাকায়। ঠাটারীবাজার, ওয়ারী, নওয়াবপুর, লিঙ্কন রোড, নয়াবাজার, কাপ্তানবাজার, ফুলবাড়িয়ার অলিতে গলিতে ছড়ানো রহস্য, ঐতিহ্যের স্বাদ নিশ্চয়ই তার লেখকমনকে দান করেছে আরো সৃজনশীলতার উপকরণ। 

বহুদিন জাপানে থেকেছেন এই গুণী ব্যক্তি। জাপানিদের থেকে তিনি জীবনে শিক্ষা নিয়েছেন, খুব বেশি আগপিছ না ভেবে মুহূর্তে বাঁচা। নিজের মতো জীবনভর আনন্দ সঞ্চয় করে গেছেন আর যখন ইচ্ছে সেইসব আনন্দ ঢেলে দিয়েছেন লেখার খাতায় ঠিক এভাবেই– ‘আকাশ যখন কচি লেবুর পাতা, খুলি তখন পদ্যি লেখার খাতা’। যেখানে যেমন দেখেছেন, যেখানে যেমন থেকেছেন– সেই অভিজ্ঞতার নির্যাস নিজের ব্যক্তিত্ব ও লেখা, উভয় ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন আলী ইমাম। 

২০২২ সালের ২১শে নভেম্বর তার জীবদ্দশার ইতি ঘটেছে ঠিকই, তবে সেইসব রেখে যাওয়া অভিজ্ঞতারা ছাপার অক্ষর হয়ে আমাদের জন্য পথ প্রদর্শক হয়ে থেকে গেছে। 

অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন। [email protected]

Share if you like

Filter By Topic