Loading...
The Financial Express

রোশেনারা: মুক্তিযুদ্ধের অনন্য এক মিথ


(বাম) যুদ্ধ ট্যাংক ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ,                            (ডান) বিকচকান্তি চৌধুরী ও আহমদ ছফা (বাম) যুদ্ধ ট্যাংক ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, (ডান) বিকচকান্তি চৌধুরী ও আহমদ ছফা

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা মারফত লোকমুখে ছড়িয়ে যায় রওশন আরার আত্মদানের কাহিনী গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে তা হয়ে দাঁড়ায় 'রোশেনারা' সে সময় বহু মানুষ এটিকে সত্য বলে মনে করলেও পরবর্তীতে নানাজনের লেখা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে এটি ছিলো মিথ রওশন আরা নামে বাস্তবে কেউ ছিলেন না, তবে এই নারী চরিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মানুষকে ভীষণভাবে করেছিল অণুপ্রাণিত 

পশ্চিম বাংলার আনন্দবাজার পত্রিকা এপ্রিল ১৯৭১ রওশন আরাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে  আগরতলা থেকে ৩১ মার্চ পাঠানো 'একজন বীরাঙ্গনা ও একটি প্যাটন ট্যাংক' শীর্ষক সেই সংবাদ সূত্রে জানা যায় , ' গত শুক্রবার (২৬ মার্চ) ঢাকা ওমেনস কলেজের প্রথম বার্ষিকীর ছাত্রী কুমারী রোশেনারা বেগম বুকে মাইন বেঁধে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় পাকিস্তানি ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রাণ দিয়ে তিনি একটি প্যাটন ট্যাংক উড়িয়ে দিলেন! ঢাকার একজন সাংবাদিক গতকাল এখানে সেই বীরাঙ্গনার কাহিনী বলেন!' কলকাতার যুগান্তর, কালান্তর সহ আরো বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে আসে রওশন আরার আত্মত্যাগের কাহিনী কলকাতার মানুষের উচ্চারণে নামটি হয়ে যায় রোশেনারা৷ 

সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী তার 'মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি: একাত্তরের রাতদিন বইয়ে উল্লেখ করেছেন , ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন এপ্রিল রোশেনারা দিবস পালনের ঘোষণা দেয় 

কলকাতার বাইরে মেদিনীপুর, মণিপুর সহ বিভিন্ন জেলা/ অঞ্চলে রোশেনারা দিবস পালিত হয় 

দিলীপ চক্রবর্তীর লেখায় এসেছে, , 'এত বড় মহিলা সমাবেশ দীর্ঘকাল কলকাতায় হয়নি৷ সে সময় বাংলাদেশের মাটিতে অসংখ্য বাঙালি তরুণীকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মবোধের জন্য তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয়েছিল, জীবনও দিতে হয়েছিল৷ তাঁরা হয়ত প্রত্যেকেই রওশন আরার প্রতীক, তাই পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের সংগ্রামী মহিলাদের প্রতি সংহতি আন্দোলন সংগঠিত করতে 'রওশন আরা' নাম সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের উদ্দীপ্ত করেছে

তবে শুরুতে ঢাকার ওমেন্স কলেজ বা ইডেন কলেজের নাম বলা হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন কাহিনীতে রওশন আরাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে দেখানো হয়৷ শহিদ বুদ্ধিজীবি আনোয়ার পাশা ১৯৭১ 'রাইফেল রোটি আওরত' লেখেন সেখানে উল্লেখ করেন

"রোশেনা কি শুধুই একটি নাম? সে একটি আদর্শ সুদীপ্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ের (উপন্যাসে সুদীপ্ত শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) একটি ছাত্রী রোশেনা৷ বাঙালি হত্যার শোধ নিতে শরীরে মাইন জড়িয়ে শত্রুসেনার ট্যাংকের নিচে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন সেই বীরদর্পিণী বঙ্গললনা রোশেনা তাই বাঙালির ঘরে একটি রূপকথার নাম'' 

বেলাল মোহাম্মদের লেখা 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' বই থেকে জানা যায়, ১৬ সেপ্টেম্বর 'আমাদের মুক্তি সংগ্রাম মহিলা' নামে একটি কথিকা পাঠ করেন মেহের খন্দকার সেখানে বলেন, "তাই দেখতে পাই ইতিহাসের পাতায় বীরাঙ্গনা খাওলা, চাঁদ সুলতানা থেকে শুরু করে জামিলা, বোখারিদ, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর লায়লা খালেদের পাশে বীরাঙ্গনা রওশনারা নিজের নাম যোজন করে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে'' 

আহমদ ছফার 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি: একাত্তরের রাতদিন ' বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের তিনটি গোলন্দাজ ইউনিটের ভেতর দ্বিতীয়টির নাম ছিলো 'রওশন আরা ব্যাটারি' ১৯ নভেম্বর কুকিতলা ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর সিলেটে শেষ অপারেশন চালায় তারা এটি ছিলো যুদ্ধকালে জেড ফোর্সের অংশ ১৯৭২ সালের মে এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হয়, নতুন নাম হয় টু ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি 

ছফা তার অলাতচক্ত উপন্যাসে রওশন আরার কাহিনীকে আরো বিস্তৃত রূপ দেন এখানে রওশন আরাকে দেখা যায়, ইডেন কলেজের ছাত্রী হিসেবে তার বাড়ি বলা হয় রাজশাহীর নাটোর মহকুমায়৷ তিনি নাটোরে মহিলা বিগ্রেড গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেন এখানে তার বান্ধবী হিসেবে শিরিন নামের একটি চরিত্রও আমরা দেখি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারপর 'জয় বাংলা' বলে সারা শরীর ট্যাংকের তলায় ছুঁড়ে দেন ঘটনাটি ঘটে নাটোরে, বগুড়া থেকে রাজশাহী অভিমুখে আসতে থাকা সেনাদের প্রতিহত করার জন্য 

ছফা এখানে সত্যের মতো প্রচার হতে থাকা ব্যাপকভাবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা ঘটনাটিকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেন কল্পনা মিশিয়ে৷ 

তবে এসব কিছু বা এতো পত্রিকার সংবাদ - সবই প্রকৃতপক্ষে ছিলো মিথ বা কল্পনা 

স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের গোলন্দাজ বাহিনী বইয়ে মেজর মামুন মাহমুদ ফিরোজ লেখেন, "স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র মুক্তিবাহিনীর মনোবল বাড়ানোর জন্য  খবরটি প্রচার করেছিল৷

তবে কর্ণেল মাহমুদুর রহমান চৌধুরী ধরণের প্রচারণাকে ইতিবাচক ভাবে নেননি৷ তিনি মনে করতেন, এর ফলে অনেক সত্যিকারের   প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব ঢাকা পড়ে গেছে

তবে এই মিথের সূত্রপাত কীভাবে তা নিয়ে আছে মতভেদ 

বেলাল মোহাম্মদের স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র বই থেকে জানা যায়, 'সেদিন মনোজ বসু বলেছিলেন- আচ্ছা, তোমাদের একটি মেয়ে রোশেনারা বুকে মাইন বেঁধে পাকিস্তানি ট্যাংকের তলায় আত্মাহুতি দিয়ে ট্যাংকটি উড়িয়ে দিয়েছিল ওটা নাকি নিতান্তই মিথ? তবে ওই গপ্পোটা যেই রটাক, খুব কাজে দিয়েছে'' 

বেলাল মোহাম্মদ তার এই বইয়ে এই মিথ এম.আর আখতার মুকুলের সৃষ্ট বলে মত দিয়েছেন তবে সে সময় এটি আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যেপাধ্যায়ের সৃষ্ট বলেও গুঞ্জন ছিলো 

উল্লেখ্য, রওশন আরা বিষয়ে প্রথম সংবাদ প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকায়, যা এসেছিল আগরতলা থেকে  আহমদ ছফার 'নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ' গ্রন্থে তিনি এর কৃতিত্ব দিয়েছেন আগরতলার সাংবাদিক বিকচকান্তি চৌধুরীকে তার লেখা থেকে, ' ইয়াহিয়াকে আমি (বিকচ) দেখে নিচ্ছি৷ সেই দেখে নেওয়ার ফল এই দাঁড়াল যে, ফুলজান নামের এক আঠারো বছরের যুবতী বুকে মাইন বেঁধে ট্যাংকের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ফলে একজন মেজর জেনারেলসহ ২৩ জন সৈন্য অকুস্থলে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে

ছফার কথামতে, তার পরামর্শেই বিকচকান্তি  ফুলজান নামটি পরিবর্তন করে রওশন আরা দেন এছাড়া তাকে ইডেন কলেজের ছাত্রী (আনন্দবাজারে ওমেন্স কলেজ ছাপা হয়) হিসেবে প্রচার করার  পরিকল্পনাও ছিলো ছফার 

সে সময় দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক মানস ঘোষ তার 'বাংলাদেশ ওয়ার' বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, স্টেটসম্যান রওশন আরার গল্পের উৎস ও সত্যতা উদঘাটনের অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি। রওশন আরার স্রষ্টাকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা না গেলেও যুদ্ধকালে এর প্রচারে অনেকেই ভূমিকা রেখেছিলেন ও এই প্রোপাগান্ডার ফলে অনেক নামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও প্রভাবিত হয়েছিলো। 

রওশন আরাকে নিয়ে সে সময় অনেক কবিতা, নাটক, গল্প লেখা হয়েছে। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ শামসুল হক, গৌরাঙ্গ ভৌমিক কবিতা লেখেন। মুহাম্মদ নুরুল কাদির লেখেন গল্প। নাটক মঞ্চস্থ করেন শ্রী দেবনারায়ণ গুপ্ত, অরুণ রায়৷ এভাবে রওশন আরা বা ' রোশেনারা' হয়ে ওঠেন বাংলার আপামর মানুষের কাছে দুর্দমনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের প্রতীক।

সৈয়দ শামসুল হক তার রোশনারা কবিতায় লেখেন, ''  ওই বুকে মাইন বেঁধে বলেছিলে- জয় বাংলা-/ মানুষের স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক,/ ট্যাঙ্কের ওপর ঝাঁপ দিতে দিতে বলেছিলে- /বর্বরতা এইভাবে মুছে যাক, ধ্বংস হোক সভ্যতার কীট।/
অন্তিমবারের মতো পথিকেরা পথে এসে দাঁড়িয়েছে, আকাশে উঠেছে ধ্রুবতারা-/ধ্রুবতারা হয়ে গেছে মুক্তির জননী রোশেনারা। 

আহমদ ছফার লেখায় এসেছে কলকাতায় শোনা গানের চরণ- “ শহীদ লক্ষ ভাই -ভগিনী শহীদ রোশেনারা/ তোমরা তো সব প্রাণের আগুন চোখের ধ্রুবতারা/ রোশেনারা বোনটি আমার/ কোন গাঁয়ে যে ছিল তোমার ঘর / সেথায় কি আজ বুটের তলে আকাশ বাতাস রৌদ্রজলে/ ধু ধু করে পদ্মা নদীর চর।'' 

যুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা মিথ তৈরি অন্যায় কিছু নয়৷ যাহিদ হোসেনের 'মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার' বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'প্রোপাগান্ডা ওয়ারফেয়ার যুদ্ধশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা বৃহত্তর পরিসরে এটিকে সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও বলে এর উদ্দেশ্য, প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে নিজদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ানো, নিজস্ব বাহিনী ও জনগণের মনোবল চাঙা রাখা, শত্রুর মনোবল দুর্বল করা ইত্যাদি।' 

রওশন আরা তথা রোশেনারাও তেমনই একটি সফল মিথ ও প্রোপাগান্ডা  বাস্তবে রোশেনারা বুকে মাইন বেঁধে ট্যাংকে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, কিন্তু এমন লাখ লাখ রোশেনারা জীবন দিয়েছেন। তারা বেয়নেটে, গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। নিঃসীম নির্যাতনের মুখেও কারো নাম বলেননি। তাই এটি মিথ হলেও তাতে মুক্তিযুদ্ধে কোনো নারীর আত্মদান বৃথা হয়ে যায়না। বরং, রোশেনারা হয়ে ওঠেন মুক্তিসংগ্রামে সংহতি জানানো সকল নারীর প্রতীক। অথবা, সকল নারীই তাদের আত্মত্যাগের জায়গা থেকে প্রতীকীভাবে হয়ে ওঠেন একেকজন রোশেনারা বা রওশন আরা।

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। 

[email protected] 

Share if you like

Filter By Topic