চট্টগ্রামের পাঁচ বছরের শিশু আয়াতকে অপহরণ ও হত্যার পর লাশ কয়েক টুকরো করে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ বলছে, ‘ক্রাইম পেট্রোল’ ও ‘সিআইডি’র মত ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখে উৎসাহ পেয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান এক তরুণ। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
গত এক দশকে এরকম বেশকিছু হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের তদন্তে নেমে একই ধরনের কথা বলেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ওই ধরনের ‘সিরিয়াল দেখে’ অপরাধের কৌশল রপ্ত করেছিলেন খুনিরা।
অপরাধ বিজ্ঞানের একজন বিশেষজ্ঞ অবশ্য বলছেন, মানুষের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব সবসময় থাকেই, সে কারণে সুনির্দিষ্ট গবেষণা ছাড়া ঢালাও কোনোকিছু বলা ঠিক না। আর এসব টিভি সিরিয়াল মানুষকে সচেতন করতেও ভূমিকা রাখে অনেক ক্ষেত্রে।
সবশেষ গত ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামের শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হলে তাদের বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার ছেলে আবীর আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে জানা যায়, স্থানীয় মসজিদে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় তাকে অপহরণ করে হত্যা করেন আবীর।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার নাঈমা সুলতানা বলেন, “আবীর জানায়, ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ‘ক্রাইম পেট্রোল’ ও ‘সিআইডি’ তার পছন্দের সিরিয়াল। সেসব অনুষ্ঠান থেকেই অপরাধ করার বোধ জন্ম হয় তার।
“মূলত, মুক্তিপণ আদায়, লাশ গুম, আলামত নষ্ট সবকিছুই টিভি সিরিয়াল থেকে শিখেছে বলে দাবি করেছে আবীর। যে কারণে শিশুটির দেহ ছয় টুকরো করে পলিথিনের প্যাকেটে মুড়িয়ে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে। আর লাশ কাটার পর বাড়িতে ট্যালকাম পাউডার ও সুগন্ধি ছিটিয়েছে।”
২০০৩ সালের ৯ মে ভারতের সনি এন্টারটেইনমেন্ট চ্যানেলে অপরাধভিত্তিক টিভি সিরিয়াল ‘ ক্রাইম পেট্রোল’ সিরিজের সম্প্রচার শুরু হয়। হাজারো পর্ব হয়েছে এই সিরিয়ালের। মূলত হিন্দি ভাষায় সিরিজটি তৈরি হলেও জনপ্রিয়তার কারণে পরে বাংলা, তেলেগু, মারাঠিসহ কয়েকটি ভাষায় সম্প্রচার করা হয়।
বাংলাদেশে ‘ক্রাইম পেট্রোল দেখে‘অপরাধে যুক্ত হওয়ার তথ্য চলতি বছরের ১৬ জুলাইয়ের আরেকটি ঘটনায় আসে। সেদিন গাজীপুরের কাশিমপুরের শৈলডুবি এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাড়ির মেঝে থেকে জাহিদুল ইসলাম নামে একজনরে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পরে তদন্তে নেমে পুলিশ জানায়, ‘ক্রাইম পেট্রোল দেখে’ জাহিদুলকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তার স্ত্রী ও তার বন্ধু। খাবারের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য প্রয়োগ করে ঘুমন্ত জাহিদুলকে বালিশচাপা হত্যা করা হয়েছিল।
গত বছরের ২১ জুন ঢাকার কদমতলীর একটি বাসা থেকে মাসুদ রানা, তার স্ত্রী মৌসুমি ইসলাম ও মেয়ে জান্নাতুলের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, ওই দম্পতির আরেক মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম একাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান। পরিবারের সদস্যদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ থেকে সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মেহজাবীন। আর একাই একাধিক ব্যক্তিকে হত্যার ওই পরিকল্পনা তিনি সাজিয়েছিলেন ‘ক্রাইম পেট্রোল দেখে’।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর গাজীপুরেরর আলোচিত শিশু সাদমান ইকবাল রাকিন হত্যার ঘটনাতেও ‘ক্রাইম পেট্রোলের’ প্রভাবের কথা জানা গিয়েছিল।
সেদিন বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে সাদমান ইকবাল রাকিনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব জানায়, ফয়সাল আহমেদ ও পারভেজ শিকদার তাকে অপহরণ করে গলাটিপে হত্যা করেন। এর মধ্যে পারভেজ ছিলেন রাকিনের গৃহশিক্ষক। এখানেও টিভি সিরিয়াল।
২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকায় গৃহবধূ হাসিনা বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে পুলিশ জানায়, গয়না ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিতে হাসিনাকে হত্যা করেন তার দেবর। তিনি কৌশল সাজান টিভি সিরিয়াল দেখে।
২০১৬ সালে সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীর হোটেল নাইস-এ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমাইয়া নাসরীনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় পুলিশ প্রথমে একে আত্মহত্যা বলে মনে করেছিল।
কিন্তু তিন বছর পর পিবিআইয়ের তদন্তে জানা যায়, ওই জুটি হত্যার শিকার হয়েছিলেন। ‘প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে’ নাইস হোটেলের দুই কর্মীকে হাত করে ভবনের এসির ফোঁকড় দিয়ে তাদের কক্ষে ঢুকে খুনের পর একইভাবে পালিয়ে যায় অপরাধীরা। সেখানেও ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখে ওই পরিকল্পনা খুনিরা সাজিয়েছিল কলে পুলিশ পরে জানায়।
এসব ঘটনা ছাড়াও ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল দিনাজপুরের হাকিমপুরের মুহাড়াপাড়া গ্রামে চার বছরের শিশু আবতাহী আল রশীদ অপহরণ ও হত্যা এবং গত বছরের ৮ জুন পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে ১৩ বছরের শিশু সালাউদ্দিন হত্যা, এ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর লক্ষ্মীনারায়ণপুরে স্কুলছাত্রী হত্যা, ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার খলসি গ্রামে দুই সন্তানসহ এক দম্পতিকে হত্যার ঘটনায়ও ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের প্রসঙ্গে উঠে আসে।
মাঠ পর্যায়ে তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজন অপরাধীদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ‘ক্রাইম পেট্রোলের’ মতো টিভি সিরিয়ারগুলোর প্রসঙ্গ টানছেন।
‘পুলিশেরও দেখা উচিত’
গত কয়েক বছরের বিভিন্ন অপরাধের প্রসঙ্গ টেনে জানতে চাইলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একসময় আমরা অনেক দোষ দিতাম, ক্রাইম পেট্রোল বন্ধ করার কথাও বলতাম। কিন্তু এখন আর ওসব বলি না। কারণ ইউটিউবে এখন একই ধাঁচের অনেক কন্টেন্ট।
“খুন তো করবে সেই সিদ্ধান্ত নিজে সে নিছে। এরপর হয়ত সে ক্রাইম পেট্রোল দেখছে। ক্রাইম পেট্রোল না থাকলেও ইউটিউবে ওরকম অনেক কন্টেন্ট আছে। ক্রাইম পেট্রোল খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, সে কারণে হয়ত এটার নাম আসছে। কিন্তু খুন করার সিদ্ধান্ত অপরাধী নিজেই নিচ্ছে। ক্রাইম পেট্রোল দেখে খুন করে নাই।”
এসব ঘটনা যে সমাজের সামগ্রিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে পিবিআই প্রধান বলেন, “বিভিন্ন কারণে খুন হয়। ২০ টাকার জন্যও খুন হয়। তারা কী জানে না যে ধরা পড়লে ফাঁসি হবে? আবার একটা লোক যখন ধীরে-সুস্থে খুন করে, তখন সে ভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় গেলে সে ধরা পড়বে না।”
তিনি মনে করেন, ক্রাইম পেট্রোলের মত অনুষ্ঠান পুলিশেরও দেখা উচিৎ, যাতে পুলিশ নিজেদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে আলোচনা থাকা উচিৎ।
‘গবেষণার আগে ঢালাও বলা ঠিক নয়’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, মানুষের ওপর গণমাধ্যমের প্রভাব নিয়ে অনেক গবেষণা ও তাত্ত্বিকদের নানা মত রয়েছে। অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের পেছনে যেসব টিভি সিরিয়ালের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে গবেষণার আগে ঢালাওভাবে বলা ঠিক নয়।
“এখন পুলিশ তদন্ত পর্যায়ে গিয়ে হয়ত বিষয়গুলো পাচ্ছে। তাই তারা এগুলো বলছে। কিন্তু টিভি সিরিয়াল দেখে হাত পাকায় এগুলো খুব সরলীকৃত বক্তব্য। এটা সবসময় ছিল সমাজের মধ্যে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এরকম আমরা অনেক দেখেছি, এমনকি আত্মহত্যার মত ঘটনাও দেখেছি। হত্যা, বুলিং, অ্যাসল্ট এরকম অনেক কিছু…।”
উল্টো দিকটাও যে ভাবা দরকার, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিয়া রহমান বলেন, “আমরা যদি এখন বলি যে ক্রাইম পেট্রোল দেখে অপরাধ করছে তারা… তার মানে কী আমাদের টিভিতে এরকম প্রোগ্রাম থাকবে না? এই ধরনের প্রোগ্রামের তো অনেক ভালো দিকও আছে। মানুষের সচেতনতা তৈরির অনেক উপকরণ এগুলো থেকে আসে।
“মানুষ অপরাধের অনেক ধরন, আইনের ছোট-খাটো অনেক বিষয়তো এসব থেকে শিখতে পারছে। এখন কথার কথা ধরেন ক্রাইম পেট্রোল বন্ধ করে দেওয়া হলো, কিন্তু ইউটিউব বা ফেইসবুক কি আপনি বন্ধ করতে পারবেন?”
এ ধরনের অপরাধের পেছনে অন্য সামাজিক কারণগুলোও যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
“বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা এসব নানা বিষয় থাকে। এগুলো অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইম পেট্রোলের থেকে। একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক সিরিয়াল দেখে অপরাধমনস্ক হচ্ছে– সেখানে তার বাবা-মা কী ভূমিকা রাখছেন?
“তারপরেও আমাদের বলতে হবে একটার ছাঁকনি থাকতে হবে। কিন্তু তার জন্য আমাদের সমস্যা সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন গবেষণা। যদি আমাদের গবেষণায় এই ধরনের কোনো অনুসন্ধান বেরিয়ে আসে, তাহলে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে পদক্ষেপ নিতে পারি। এটাই বিজ্ঞানসম্মত। পুলিশের পক্ষ থেকেও এই ধরনের বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করা উচিৎ। আমি একটা কথা বললাম, কাউকে দায়ী করলাম কিন্তু এর সমাধানটা কী?”
চলচ্চিত্র প্রযোজক মীর মোকাররম হোসেনও এ বিষয়ে একমত। বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে তিনি বলেন, অপরাধনির্ভর টিভি সিরিয়াল দেখে মানুষ অপরাধপ্রবণ হচ্ছে এরকম অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে বলা যায়, এসমস্ত সিরিয়াল দেখে সাধারণ মানুষ অপরাধের বিভিন্ন প্যাটার্ন সম্পর্কে জানছে। যা তাদের সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
“সব কন্টেন্টেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থাকে। আর অপরাধ নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত ধারার পুলিশিংয়ের পাশাপাশি সচেতনতার ভূমিকাও অনেক। প্রো-অ্যাক্টিভ পুলিশিংয়ের অন্যতম উপকরণই হচ্ছে সচেতনতা তৈরি। এসব নিয়ে রিসার্চ থাকা উচিৎ। “যারা কন্টেন্ট বানায় তারা তো কেউ এই সমাজের বাইরের মানুষ নন। তারা এই সমাজেরই অংশ। কাজেই সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণায় যদি কোনো বিষয় উঠে আসে, তাহলে কন্টেন্ট নির্মাতারা আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে পারেন।”