ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে যারা পরিচিত তারা নিশ্চয়ই জানেন, এতদিন যে ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ গাওয়া হত, রানির মৃত্যুতে তাতে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। রানির বড় ছেলে চার্লস হচ্ছেন রাজা এবং ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধান। তার নামেই এখন থেকে জাতীয় সংগীতে গাওয়া হবে ‘গড সেইভ দ্য কিং’।
এ পরিবর্তন কেবল জাতীয় সংগীতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। আগামী কয়েক বছরে দেশটির বহুল ব্যবহৃত রয়্যাল স্টাম্প, কয়েন, ব্যাংক নোট- এমনকি পাসপোর্টেও পরিবর্তন আনতে হবে।
অবশ্য রানির ছবি সম্বলিত পুরনো কিছু অবৈধ বা বাতিল হচ্ছে না। নতুন করে সবকিছু তৈরির জন্য নতুন রাজার মুখচ্ছবি প্রস্তুতির কাজ ইতোমধ্যে শুরু করেছে প্রশাসন। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া কোথায় কোথায় পড়তে পারে তারই বিশ্লেষণ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
ব্যাংক নোটে বদল
রানির মুখচ্ছবি সম্বলিত প্রায় ২৯ বিলিয়ন কয়েনের মধ্যে সবশেষ নকশাটি তৈরি হয়েছিল ২০১৫ সালে। তখন রানির বয়স ছিল ৮৮ বছর। তার শাসনামলে সেটি ছিল কয়েনের পঞ্চম সংস্করণ।
বিবিসি বলছে, যুক্তরাজ্যের একমাত্র কয়েন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়্যাল মিন্ট নতুনভাবে রাজার মুখচ্ছবি সম্বলিত কয়েন ঠিক কবে নাগাদ বাজারে ছাড়বে, তা প্রতিষ্ঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে না। তবে রানির ছবি সম্বলিত কয়েন যে যুক্তরাজ্যে আরও বহু বছর চলবে, তাতে সন্দেহ নেই। কাজটি দীর্ঘমেয়াদী, প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটি চলবে ধীরে ধীরে।
এর আগে ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ মুদ্রা হালনাগাদের আগের কয়েনে একাধিক রাজার ছবি থাকা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
রাজা চার্লসের মুখের ছবি সম্বলিত কয়েন কেমন হতে পারে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানা না গেলেও, কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় ২০১৮ সালের একটি কয়েন থেকে। প্রিন্স অব ওয়েলস চার্লসের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে তখন একটি কয়েন বাজারে ছেড়েছিল রয়্যাল মিন্ট।
রীতি অনুযায়ী নতুন কয়েনে রাজার মুখের বাঁ দিকের অবয়ব থাকবে। ঐতিহ্যগতভাবে প্রত্যেক রাজতন্ত্রের শুরুতে এটি পরিবর্তিত হবে। এতদিন প্রচলিত সব কয়েনে রানির মুখের ডান দিক থাকত। সরকার নতুন নকশা তৈরি করে দিলেই রয়্যাল মিন্ট নতুন কয়েন উৎপাদনে যাবে।
১৯৬০ সালের পর থেকে ইংল্যান্ডের সব ধরনের ব্যাংক নোটেও রয়েছে রানির ছবি। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়নের ব্যাংক নোট পাওয়া যায়, যার বাজার মূল্য অন্তত ৮০ বিলিয়ন পাউন্ড। কয়েনের সঙ্গে সঙ্গে তাও ক্রামান্বয়ে প্রতিস্থাপিত হবে।
তবে খুব তাড়াতাড়িই সব হচ্ছে না। সে পর্যন্ত প্রচলিত নোটগুলোও চালু থাকবে। এসব পরিবর্তন করতে হলে ইংল্যান্ডের ব্যাংকগুলোকেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে।
স্ট্যাম্প ও পোস্টবক্স
১৯৬৭ সালের পর থেকে রয়্যাল মেইলের সব ধরনের স্ট্যাম্প বা ডাক টিকেটে রানির এক দিকের মুখচ্ছবি রয়েছে।
রানির মৃত্যুতে সেই ডাকটিকেট আর ছাপানো হবে না। তবে যেগুলো ছাপা হয়ে গেছে, সেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। সেগুলো চালু রেখেই নতুন স্ট্যাম্প তৈরির কার্যক্রম চলবে।
এর আগে চার্লসের ছবি সম্বলিত স্ট্যাম্প বাজারে ছেড়েছিল রয়্যাল মেইল। তবে নতুন স্ট্যাম্প কেমন হবে, তার কোনো ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি।
ডাকটিকেটের রাজার মুখচ্ছবির পাশাপাশি রয়্যাল মেইলের পোস্টবাসের ওপরও রাজকীয় সাইফার বা রাজ চিহ্ন অঙ্কিত থাকে।
যুক্তরাজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পোস্টবক্সে ‘ইটুআর’ লেখা দেখা যায়। এর অর্থ ই- এলিজাবেথ, মাঝে রোমান হরফের সংখ্যা দুই এবং আর অর্থ রেজিনা, যার অর্থ রানি। স্কটল্যান্ড অবশ্য ব্যবহার করে স্কটিশ মুকুট।
আগামী কয়েক বছরেই ইংল্যান্ডে রাজা চার্লসের সাইফার সম্বলিত পোস্টবক্স দেখা যাবে বলে ধারণা দিয়েছে বিবিসি।
রাজকীয় সিল
ইংল্যান্ডে ‘টমেটো কেচাপ’ থেকে শুরু করে খাদ্যেশস্যের প্যাকেটেও অনেক সময় রয়্যাল সাইফার দেখা যায়। সেখানে লেখা থাকে, ‘বাই দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট টু হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন’।
এর অর্থ হল, ওইসব পণ্য রাজ পরিবারের অনুমোদিত। এসব পণ্য রাজপরিবারেও সরবরাহ করা হয়।
বর্তমানে প্রায় ৮০০ কোম্পানির অন্তত ৯০০ পণ্যে এ ধরনের সাইফার দেখা যায়। রীতি অনুযায়ী যখন অনুমোদনকারীর মৃত্যু হয়, তখন কোম্পানিগুলো দুই বছরের সময় পায় সেই সাইফার ব্যবহারের। ব্যতিক্রম হিসেবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মায়ের মৃত্যুর পর তা পাঁচ বছর ছিল।
বদলাবে পাসপোর্ট
রানির মৃত্যুতে ব্রিটিশ পাসপোর্টেও আসবে কিছু পরিবর্তন। সেখানে লেখা ‘টু হার ম্যাজেস্টি’ থেকে ’টু হিজ ম্যাজেস্টি’ শব্দটির পরিবর্তন আসবে। তবে পুরনো নকশায় রানির নামে জারি করা সব ধরনের পাসপোর্টও ভ্রমণের জন্য বৈধ থাকবে।
একই সঙ্গে পরিবর্তন আসবে ইংল্যান্ড ও ওয়েল্স পুলিশের হেলমেটে ব্যবহৃত রয়্যাল মনোগ্রামে। এতদিন সেটি ছিল রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামের সাইফার সম্বলিত, যেখানে ইটুআর লেখা রয়েছে। ‘কুইনস কাউন্সেল’ হবে ‘কিংস কাউন্সেল’।
‘গড সেইভ দ্য কিং’
১৯৫২ সাল থেকে যে জাতীয় সংগীত ব্রিটিশরা গেয়ে আসছিলেন, তা বদলে যাবে।
এখন থেকে ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ এর বদলে ‘গড সেইভ দ্য কিং’ গাইবে সবাই। নিউ জিল্যান্ডেরও জাতীয় সংগীত এবং অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার রাজকীয় সংগীতেও একই পরিবর্তন আনতে হবে।
কুইনের বদলে কিং ছাড়া জাতীয় সংগীতের মূল কথাগুলো একই থাকবে। ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনে যিনি থাকেন, তার ওপর নির্ভর করেই জাতীয় সংগীতের ভাষায় ওই পরিবর্তন হয়। কোনো আইনি বাধা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে ভাষার ওই পরিবর্তন করা যায়।
আনুষ্ঠানিকভাবে চার্লসকে রাজা ঘোষণার পর সেন্ট জেমস প্যালেসের বারান্দা থেকে একটি সর্বজনীন ঘোষণাও আসবে, সেখানে বলা হবে- ‘ইশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন’। তারপরই তা একসঙ্গে গাওয়া হবে।
নতুন রাজা চার্লস কমনওয়েলথেরও প্রধান হবেন। ৫৬টি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং ২৪০ কোটি মানুষের সংগঠন কমনওয়েলথ। তারমধ্যে যুক্তরাজ্যসহ ১৫টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন তৃতীয় চার্লস।