রংপুরে আ. লীগ সমর্থকের প্রশ্ন, ‘আমরা তো দ্বিতীয় হতে পারতাম, হাতপাখা এল কোথায় থেকে’


FE Team | Published: December 28, 2022 23:19:39 | Updated: December 29, 2022 18:18:13


মঙ্গলবার লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী।

মঙ্গলবারের রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা দ্বিতীয়বারের মত বিপুল ভোটের ব্যবধানে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়লাভ করেন।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. আমিরুজ্জামান প্রার্থী হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে থাকা কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রকৌশলী মো. লতিফুর রহমান হাতি প্রতীকে পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া নৌকা মার্কায় পেয়েছেন ২২ হাজার ৩০৬ ভোট।

এ নির্বাচনে মেয়র পদে ক্ষমতাসীন দলের এমন ভরাডুবিতে অনেক কারণের সঙ্গে বেশি আলোচনায় এসেছে প্রার্থী মনোনয়নের বিতর্ক।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, যারা নির্বাচন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে এমন একজনকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে; যিনি তৃণমূলের কাছে ‘ততটা’ পরিচিত নন। নির্বাচন পরিচালনায় দলের ‘সমন্বয়হীনতাও’ তার জামানত বাজেয়াপ্তের একটি কারণ।

রংপুর বরারবরই জাতীয় পার্টির ‘ঘাঁটি’। তাই বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেখানে চতুর্থ অবস্থানে চলে যাবেন- এমন খারাপ অবস্থাও সেখানে দলের নয়। সে কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দলের এমন ফলাফলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা অনেকটা হতাশ হয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাদের কেউ কেউ।

ভোটের পরদিন বুধবার দুপুরে নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ড ঘুরে কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে ‘প্রার্থী-দুর্বলতার’ কথাই শোনা গেল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের দুজন ভোটার রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

একজন বললেন, “মোস্তফা শক্তিশালী প্রার্থী, মানলাম। আমরা তো দ্বিতীয় হতে পারতাম। হাতপাখা এল কোথা থেকে? তাদের তো এখানে ঘাঁটি নেই। তারাও ৫০ হাজার ভোট পেয়েছে। দলের লোকজনই এই নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেয়নি। হয়ত তাদের কেউ কেউ বিদ্রোহীকে দিয়েছে, কেউ জাতীয় পার্টিকে দিয়েছে। নাহলে তো এটা হওয়ার কথা না।”

আরেকজন বলেন, “আওয়ামী লীগ তো দলেরই ভোট পায়নি। মানলাম, বিএনপির লোকজন জাতীয় পার্টিরে ভোট দিছে, হাতপাখারে ভোট দিছে। আওয়ামী লীগের ভোট কই গেল?“

গত নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়েছেন কিন্তু এবার দেননি এমন একজন ভোটার বলেন, “যারে চিনি না, তারে তো ভোট দিতে পারি না। প্রার্থীরে না দেখলে কারে ভোট দেব।”

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের রংপুরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আতিকুল আলম কল্লোল বলেন, “রংপুরের মানুষ অনেকটা আবেগপ্রবণ। তারা আবেগের কারণে যুগ যুগ ধরে লাঙ্গলে পড়ে আছেন। কাকে ভোট দিলে এলাকার উন্নয়ন হবে, সেটা মানুষ এখনও বোঝেনি।”

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল বুধবার বিকালে জানান, “আমরা তো প্রার্থীকে নিয়ে মাঠেঘাটে কাজ করেছি। যতটুকু সম্ভব ভোটারদের কাছে গিয়েছি। কিন্তু তারপরও কেন এমন হলো সেটি বুঝতে পারছি না।”

তুষার কান্তি নিজেও মেয়র পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। টিকেট না পেয়ে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, “নৌকার প্রার্থী আগে সংরক্ষিত আসনে নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি ছিলেন। কিন্তু তিনি তৃণমূলের নেতা নন। সরাসরি ভোটের জন্য এমন প্রার্থী নির্বাচন মনে হয় ঠিক হয়নি।

“মানুষ তাকেই ভোট দেয়, যাকে সবসময় পাশে পায়। প্রার্থীর সেই জায়গাটায় ঘাটতি ছিল। দলের তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গেও উনার সম্পৃক্ততা কম। সব মিলিয়েই ভোটের চিত্র এমন হয়েছে। ধারণার চেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে।”

জাতীয় পার্টির রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “রংপুর এরশাদের ঘাঁটি, লাঙ্গলের ঘাঁটি। তারপরও এখানে আওয়ামী লীগের ৫০ থেকে ৬০ হাজার ভোট আছে। গত অনেকগুলো নির্বাচনে সেটা দেখা গেছে।”

জাপা নেতা বলেন, “এবার সেই ভোট আওয়ামী লীগ প্রার্থী টানতে পারেননি। কারণ, তাদের প্রার্থী মনোনয়নে ভুল ছিল। যাকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে দলের নেতাকর্মীরাই তাকে মানতে পারেননি। ফলে নির্বাচনে তাদের কোনো সমন্বয় ছিল না। সেটা ভোটের প্রচারের সময়ই দেখা গেছে। আমার মনে হয়, এই কারণে ভোটের ব্যবধান অনেক বেড়েছে, নৌকার ভরাডুবি হয়েছে।”

রংপুর সিটির প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও এবারের নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। দুইবারই দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন কাওসার জামান বাবলা। তিনি দুবারই ৩০ হাজারের কম ভোট পেয়েছেন।

এবার বাবলা নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না- এই নীতির কারণে তিনি নির্বাচনে আসেননি।

বিএনপির রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “আওয়ামী লীগ বাকশাল কয়েম করতে চায়, এটা রংপুরবাসী বুঝে গেছে। এ কারণেই মানুষ তাদের প্রত্যাখান করেছে। তাদের প্রার্থী মাত্র ২২ হাজার ভোট পেয়েছে।”

রংপুরে ভোটে লড়তে প্রচার চালিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর রংপুর মহানগর শাখার সাবেক আমির সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলালও। তিনি শেষ মুহূর্তে মাঠ থেকে সরে যান।

১৮৬৯ সালের ১ মে গোড়াপত্তন হয় রংপুর পৌরসভার; ৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরে তখন ১৫টি ওয়ার্ড ছিল। প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন রংপুরের কালেক্টর ই জি গ্লেজিয়ার। আব্দুর রউফ মানিক সবশেষ পৌরসভা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১২ সালের ২৮ জুন পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের সঙ্গে বর্ধিত এলাকার (সাবেক সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন থেকে) আরও ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত করে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন গঠন করা হয়। পৌরসভার আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২০৩ বর্গকিলোমিটার।

Share if you like