মিয়ানমারে সহিংসতা ও রোহিঙ্গা সঙ্কটের অবসানে নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবার প্রস্তাব পাস


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: December 22, 2022 12:45:14 | Updated: December 22, 2022 17:05:33


২০১৭ সালে সেনা অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালাচ্ছে রোহিঙ্গারা। ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

মিয়ানমারে সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবসনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বানে প্রথমবারের মত একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। à¦–বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

বুধবার নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত এ প্রস্তাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করা হয়।

মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা যে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলবে, সে বিষয়টিও দৃঢ়ভাবে তুলে ধরা হয় প্রস্তাবে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাবের পেন হোল্ডার (সড়া প্রস্তাব উত্থাপনকারী এবং মূল স্পন্সর) ছিল পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্য। তিনমাস ধরে আলোচনা শেষে বুধবার ১২-০ ভোটে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়।

ভোটাভুটি পর্বে প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো সদস্য ভোট দেয়নি বা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কোনো সদস্য ভেটো দেয়নি । ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল।

রয়টার্স লিখেছে, গত ৭৪ বছরের মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রথম মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো প্রস্তাব গৃহীত হল, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে সহিংসতা বন্ধের দাবি জানানোর পাশাপাশি ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চি সহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সামরিক জান্তার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার, টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন।

মানবিক কারণে এতদিন ধরে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এলেও বাংলাদেশ শুরু থেকেই এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিরাপদে, টেকসই ও মর্যাদার সঙ্গে তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার জন্য জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের তৎকালীন সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও করে।

এরপর ২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

এর মধ্যে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তার দলের অধিকাংশ নেতাকে গ্রেপ্তার করলে মিয়ানমারের সঙ্কট ঘনীভূত হয়। এর পর থেকে গণতন্ত্রপন্থি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে হাজারো মানুষের প্রাণ গেছে সেখানে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, “নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি অনুমোদন করায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মিত কার্যকলাপের অংশ হয়ে গেল। একই সাথে এটি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের এতদসংক্রান্ত অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালি ও ত্বরান্বিত করবে।”

প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড বলেন, “আজ আমরা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় একটি বার্তা দিলাম। আমরা চাই এ প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হোক, এ নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কোনো সন্দেহ থাকা উচিত হবে না।

“আমরা মিয়ানমারের জনগণের জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা আজ দিলাম, আমরা তাদের অধিকার, তাদের ইচ্ছা এবং তাদের স্বার্থকে সমুন্নত রেখেই পরিস্থিতির উন্নতি চাই।"

মিয়ানমার সঙ্কট কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, তা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বিভক্তি দীর্ঘদিনের। মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও রাশিয়া বরাবরই কঠোর কোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করে এসেছে। তাদের পাশাপাশি ভারতও বুধবার ভোটদানে বিরত থাকে।

ভোটাভুটির পর জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন পরিষদকে বলেন, “চীনের এখনও এ বিষয়ে উদ্বেগ আছে। এ সঙ্কটের সহজ কোনো সমাধান নেই... শেষ পর্যন্ত সঠিকভাবে এর সমাধান করা যাবে কি না, তা পুরোপুরি মিয়ানমারের উপরই নির্ভর করে।"

রয়টার্স জানিয়েছে, চীন চেয়েছিল নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি গ্রহণ করুক, প্রস্তাব নয়।

জাতিসংঘে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেছেন, মস্কো মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে না। সে কারণে মস্কো বিশ্বাস করে, মিয়ানমারের সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জড়ানো উচিত হবে না।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, "সঙ্কট মোকাবেলা এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বার্মার সামরিক জান্তার ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে এটা নিরাপত্তা পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।"

ভোটাভুটি শেষে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, মেক্সিকো, গ্যাবন ও নরওয়ের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্যে প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রশংসা করেন এবং এ সমস্যার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের জোরালো ভূমিকার দাবি জানান।

আর বাংলাদেশ মিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “বলা বাহুল্য, এই রেজুল্যুশনটি রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানের প্রতি জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অঙ্গটির শক্তিশালী সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। রাশিয়া-ইউক্রেইন সঙ্কটসহ অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে গৃহীত রেজুল্যুশনটি রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আরো সুসংহত করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।”

মিয়ানমার সঙ্কটের সমাধানে ২০২১ সালে আসিয়ানের গৃহীত পাঁচ দফা ঐকমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে নিরপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবে।

এর বাস্তবায়নে জাতিসংঘের কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হবে কিনা সে বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতকে ২০২৩ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেছে নিরাপত্তা পরিষদ।

বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, এ প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণে ‘উল্লেখযোগ্য ভূমিকা’ পালন করেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী ও অস্থায়ী বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন এবং বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যাতে রেজুল্যুশনে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

“নিরাপত্তা পরিষদের ডিসেম্বর ২০২২ এর সভাপতি ভারত এবং তাদের সভাপতি থাকাকালীন সময়েই রেজুল্যুশনটি নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হল। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টায় সফল হল বাংলাদেশ।”

Share if you like