দুদিন বন্ধ থাকার পর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আবারও ভারী গোলাবারুদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে; এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাতের মধ্যে মঙ্গলবার সকাল থেকে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দারা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মঙ্গলবার সকাল ৮টার আগে থেকে সীমান্তের ওপারে ভারী গোলাবারুদের শব্দ শুনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর শুধু গুলির আওয়াজ আসে। মনে হচ্ছে, আমাদের পুরো সীমান্ত এলাকা কেঁপে উঠছে।
“এখন ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়’- এর অবস্থা আমাদের। সবাই ভয় ও আতঙ্কে আছে। কিন্তু এলাকা ছেড়ে যাব কোথায়?”
সীমান্ত এলাকাবাসী আপাতত যার যার ঘরে অবস্থান করছে। সীমান্তজুড়ে এখনও বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কবাস্থায় রয়েছে জানান স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ইসলাম দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সীমান্ত এলাকার জনপ্রতিনিধিরা আমাকে সকাল থেকে গোলাগুলির খবর জানিয়েছেন। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খুব জরুরি না হলে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। তারা যেন ঘরের ভেতর থাকেন। বাচ্চাদের ঘরে রাখেন।
“অনেক সময় দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা গভীর বনে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে যান এবং সেখানে পাহাড়ের ঢালে অনেকেই জুম চাষও করে থাকেন। যেহেতু সেখানে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলছে তাই আপাতত তাদেরকে এসব কাজ কিছুদিনের জন্য বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।”
ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকও গোলাগুলির তথ্য জানিয়েছেন বলে জানান ইউএনও সালমা ইসলাম। তিনি আরও বলেন, “গত দুদিন গোলাগুলির বন্ধ থাকার অনেকে শিক্ষার্থী স্কুলে আসছিল। কিন্তু আজ সকাল থেকে আবার গোলাগুলি শুরু হওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা সীমান্তের ওপারে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পারছে।”
“আমরা সবাইকে প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানানোর জন্য বলেছি। এবং সংঘাতপ্রবণ সীমান্ত এলাকা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছি। এলাকায় বিজিবির টহল চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। গোটা পরিস্থিতিই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে”, যোগ করেন ইউএনও।
সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে কক্সবাজার-৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মেহেদী হোসাইন কবিরকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে এ ব্যাপারে বিজিবি পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান গত শনিবার ঢাকায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তারা প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করছেন এবং তথ্য সংগ্রহের কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও জেলা পুলিশ প্রশাসনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মিয়ানমার বিষয়ক সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থান লক্ষ্য করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বোমা বর্ষণ করে।
সংঘাতের মধ্যে গত ২৮ অগাস্ট দুপুরে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে।
এরপর ৩১ অগাস্ট রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহরতলীতে আরাকান আর্মির সদস্যরা একটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে হত্যা করে বলে প্রকাশিত সংবাদে দাবি করা হয়। আরাকান আর্মির দখলে নেওয়া পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিতে সেনাবাহিনী এগোচ্ছে।
এর মধ্যে গত শনিবার মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারে গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে।
এসব ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে দুইবার ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “এটা উসকানিমূলক না। এটা স্ট্রে (আকস্মিক চলে এসেছে)।”
টানা তিন সপ্তাহ ধরে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়ার পর রোববার ও সোমবার কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার সকাল থেকে ফের গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া গেলেও কোনো যুদ্ধবিমান বা ফাইটিং হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোলাগুলির কারণে অনেকেই বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। তারা সীমান্ত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করছেন। সীমান্ত এলাকায় রাবার বাগানে যেসব শ্রমিক কাজ করেন তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আপাতত সেখানে শ্রমিকরা কাজ করতে যাচ্ছেন না।
এদিকে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পালিয়ে আসা ৬২১টি পরিবারে চার হাজার ২০০ রোহিঙ্গা এখনও তুমব্রু সীমান্তের কোনাপাড়ার শূণ্যরেখার আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছে। গোলাগুলির কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে রোববার বিকালে ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “যে জায়গাগুলোতে এটা (গোলাগুলি) হচ্ছে, সেখানে রোহিঙ্গারা থাকেন না। রোহিঙ্গারা থাকেন ঠিক তার বিপরীত দিকে, ইস্টার্ন সাইডে। এটা হচ্ছে পশ্চিমে, আমাদের বর্ডার ঘেঁষে একেবারে। যে জায়গাটা এরই মধ্যে একেবারেই রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর ধরে।”
শূন্যরেখার অবস্থান করা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসতে পারেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “২০১৭ সালে আমাদের কাছে যে তথ্যগুলো ছিল না, এখন অবশ্যই কিছুটা হলেও আছে। সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা কমেন্ট করতে চাই না। আমরা এবার অন্ততপক্ষে কোনো ঢলের শঙ্কা করছি না বা আশাও করছি না।”