মনোয়ার তেহারি: ১০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা - যেকোনো দামে


মাহমুদ নেওয়াজ জয় | Published: November 20, 2022 16:43:25 | Updated: November 21, 2022 10:33:09


মনোয়ার তেহারি: ১০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা - যেকোনো দামে

মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের বিরিয়ানীর গলি অনেকের কাছেই সুপরিচিত। বিশেষত মোহাম্মদপুর নিবাসীদের কাছে। বোবা বিরিয়ানী, কামাল বিরিয়ানীর মত দোকানগুলো যে গলিতে আছে, সেই গলিতেই যদি একটু রাতে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যান ; কামাল বিরিয়ানী যাওয়ার আগেই চোখে পড়বে মোটাসোটা গোফওয়ালা একজন বিরিয়ানী বিক্রেতাকে। বেগম পান বিতান নামের দোকানটির বিপরীতে রাত ১১ টার দিক থেকে বসতে দেখা যায় তাকে।

এই বিরিয়ানি বিক্রেতা জেনেভা ক্যাম্পের পরিচিত মুখ। একসময় ছিলেন কামাল বিরিয়ানী হাউসের হেড বাবুর্চি। নাম মো. মনোয়ার। কামাল বিরিয়ানী ছেড়েছেন একমাসের কিছু বেশি। এখন বেগম পান বিতানের বিপরীতে লাল কাপড়ে মোড়ানো বড় ডেকচিতে করে বিরিয়ানি বিক্রি করেন।

একদিন রাতে ক্যাম্পের সেই গলিতে গিয়ে দেখা গেলো বিরিয়ানী বিক্রি করছেন তিনি। রাত তখন এগারোটা পেরিয়েছে। তাকে সাহায্য করছেন আরো একজন তরুণ, সাথে আর একটি ছোট ছেলে।

আশেপাশের মানুষ ততক্ষণে জড়ো হয়েছেন তার বিরিয়ানীর হাড়ির সামনে। এটি পাক্কি বিরিয়ানী অর্থাৎ, সোজা কথায় তেহারী। তবে এরকম আরো কিছু স্থানীয় ড্যাগ (ডেকচি) বিরিয়ানী আছে, যেগুলো মুরগির। এটি গরুর।

স্থানীয় মানুষজন খেতে খেতে প্রশংসা করছিলেন, সাথে বেশিরভাগেরই প্রধান প্রশ্ন- 'কামালের দোকান ছাড়লা কবে?'

তারপর কথা হলো তার সঙ্গে। একপ্লেট আশি টাকার তেহারি হাতে। মো. মনোয়ার কণ্ঠে একটু আক্ষেপ নিয়েই বললেন, ' আমি কামাল বিরিয়ানীতে ছিলাম ২২ বছর। ২০০০ সাল থেকে, তখন আমার বয়স কত- জন্ম ১৯৮৪ তে, তাহলে ধরেন ১৬ বৎসর। এর আগে কিছু করতাম না। ওনার দোকান দিয়েই শুরু হইছিলো। কিন্তু এত বছর পর এসে মনে হচ্ছিলো যে মেহনত করতেছি, সময় দিচ্ছি - সেটার ফল পাচ্ছিনা ঠিকঠাক। তাই মাসখানেক হয় নিজেই দোকান করলাম। ''

শৈশব- কৈশোরের কথা স্মরণ করে বললেন, "আমার আব্বা লালবাগের মানুষ। ওদিকে যে মসজিদ আছে সেইদিকে বাসা আমাদের। ওনার স্যালুনের ব্যবসা আছে। পরে আমরা এদিকে থাকতে আসলাম। আমার বালক বয়স হবে তখন। আমার আব্বা, আম্মা, ছোটভাই আছে। ছোট ভাই এই দোকানে সাহায্য করে আমাকে। আর এই ছোট ছেলেটা- ও আমার ছেলে, সাথে থাকে। ''

দোকানের বিপরীতে থাকা ফুলের দোকানটির মালিক জাভেদ আলী বললেন, " ওরে তো সেই ছোটবেলা থেকে চিনি। ছেলেটার রান্না অনেক ভালো। কামাল বিরিয়ানী অন্যরকম নাম করছিলো ও আসার পর। কিন্তু বোঝেনই তো, অনেকসময় মানুষ কাজের ঠিক দামটা পায়না। তাই ওকে আমরাও বললাম, বাইশ বছর ওদের জন্য কাজ করছো, এখন নিজে কিছু করো।"

মো. মনোয়ার এর দোকানের সামনে তখন লোক একটু কমেছে, রাতও বাড়ছে।

তবে স্থানীয় ছোট ছেলেরা বিরিয়ানী নিয়ে যাচ্ছিলো পলিথিনে। এদের একজন বললো, 'বাই (ভাই), এইখানে অল্প দামে ভালো (বিরিয়ানি) দেয়। এই ধরেন ২০ টাকার নিই। ভালো হয়।'

মো. মনোয়ার বললেন," আমি কোনো ফিক্সড দাম বা সেট বানাইনি। যত টাকার চাইবেন দিবো। ১০ টাকা বললে তাও আছে, আবার সর্বোচ্চ ৫০০ টাকারও নিতে পারবেন পার্সেল। সেটা বক্সে দেয়া যাবে। তবে অল্প হলে, যেমন ২০ টাকা, ৩০ টাকা, ৫০ টাকা হলে পলিথিনেই দেই।"

তার তেহারিতে (৮০ টাকায়) গরুর মাংসের ছয়টি ছোট টুকরা পাবেন। সাথে বেশ ভালো পরিমাণে পোলাও। একজনের পক্ষে শেষ করার জন্য একটু বেশি মনে হতে পারে। সাথে আছে দু’ টুকরো আলুও। অনেক জায়গায় তেহারিতে আলু দেয়ার চল নেই৷ এখানে দেয়া হয়, প্রকৃতপক্ষে তেহারিতে নাকি আলু থাকার কথা স্বাভাবিকভাবেই।

বাজারে গরুর মাংসের যে দাম তাতে এই মাংস দেয়া কতটুকু লাভজনক, এমন প্রশ্ন শুনে বললেন, " আমি তো থাকিই এইদিকে। দোকান ভাড়া দেয়ার ব্যাপার নাই। ডেকচি নিয়ে বিরিয়ানী বেচি। লাভ তারপরও একটু কমই উঠে, তবে যা উঠে তা আলহামদুলিল্লাহ ভালো।"

এতদিন একটি সনামধন্য দোকানে ছিলেন। এখন থেকে একা একজায়গায় দাঁড়িয়ে বিরিয়ানী বিক্রি কি কষ্টদায়ক কোনোভাবে- এমন প্রশ্ন শুনে হাসলেন। বললেন, " মানুষের জীবনের রাস্তা সবসময় এক থাকেনা, মামা। আমি ওখানে বাইশটা বৎসর ছিলাম, যখন ঢুকি তখন ক্যাম্প এখনকার মতো ছিলো না। দোকানগুলা তখন ছোট। কামাল ভাইয়ের বউ, মানে ভাবি চপ (টিকিয়া) , রোস্ট বা ফিরনি বানায় দিতেন। সেসব নিয়ে এসে বেচতাম। আর আমরা বাকিরা মিলে বিরানী রানতাম। প্রথমদিকে তো খুব অল্প করে বেচা-বিক্রি হতো। তারপর এত বছরে ওরা অনেক বড় হইছে, কিন্তু একসময় মনে হলো যেভাবে হইতে পারতো, ওইভাবে বদলটা আমার হয়নাই। তাই নিজের মতো করেই শুরু করছি। রাত্রে ১১ টা থেকে সাড়ে ১২ টার মধ্যে সব বিক্রি হয়ে যায়। প্রতিদিন ১৫-২০ কেজি চালের বিরানী বিক্রি হয়। মাংস লাগে ৩০ কেজি মত। ক্যাম্পের স্থানীয়রাই খায় বেশি। তাই ১০ টাকা বা ২০ টাকারও বেচি। "

তার মুখে তখন একরকম প্রত্যয় ও তৃপ্তি। তখনো বেশকিছু মানুষ খাচ্ছেন, পার্সেল নিচ্ছেন। উনি বললেন, " খাবার যদি খারাপ লাগে, কিছু বলার থাকে, অবশ্যই বলবেন। আর শুধু দোয়া করবেন, আর কিছু লাগবেনা।"


মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

mahmudnewaz939@gmail.com

Share if you like