সাইবারাবাদ পুলিশের গোয়েন্দাদের কাছে নারী পাচার এবং যৌনকর্মীদের সম্বন্ধে যেরকম নিয়মিত তথ্য আসে, সেভাবেই শুরুটা হয়েছিল।
কয়েকটা জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে যৌন কর্মী এবং খরিদ্দারদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তদন্ত চালাতে গিয়ে আরও তথ্য সাইবারাবাদ পুলিশের মানব পাচার রোধ বিভাগের হাতে আসতে থাকে। খবর বিবিসি বাংলার।
"প্রথম গ্রেপ্তারিটা আমরা করেছিলাম নভেম্বরের মাঝামাঝি। তার নাম সালমান। এরপরে অর্ণভ নামে একজন ধরা পরে।
এদের জেরা করে আর মোবাইল কল ডিটেইলস ইত্যাদি পরীক্ষা করে আমরা মূল চক্রী কোথায় থাকে সেটা জেনে যাই।
হায়দ্রাবাদ শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা উচ্চবিত্ত পাড়ায় হানা দিয়ে আমরা মূল চক্রী আদিম আর তার বান্ধবী হরভিন্দর কউরকে ধরে ফেলি।
তারা দুজনেই তখন ড্রাগসের নেশা করছিল," বলছিলেন সাইবারাবাদ পুলিশের অপরাধ দমন শাখার অতিরিক্ত কমিশনার কভিথা দারা।
চক্রের খোঁজ যেভাবে পাওয়া গেল
একদিকে যখন হায়দ্রাবাদ আর সাইবারাবাদে যৌন ব্যবসা চালানো ব্যক্তিদের খোঁজ চলছিল, তখনই তেলেঙ্গানার অনন্তপুর আর বেঙ্গালুরুতেও পুলিশের দল পাঠানো হয়। একে একে মুম্বাই আর দিল্লি থেকেও চক্রীরা ধরা পরে।
গোটা চক্রটির কাজকর্ম কীভাবে চলত তা যখন সামনে আসে, তাতেই মিজ দারা আর তার তদন্তকারীদের দল বুঝতে পারে বহু দূর পর্যন্ত এই চক্রের জাল ছড়িয়েছে।
মিজ দারা জানাচ্ছিলেন, "এই চক্রটির দালালরা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকত। তারাই এলাকার অভাবী নারীদের খুঁজে বার করত, তাদের ছবি যোগাড় করে রাখত। এই নারীদের লোভ দেখানো হত ভাল বেতনের চাকরীর, উন্নত জীবনযাত্রার।"
গোটা কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হত সামাজিক মাধ্যম, বিভিন্ন ওয়েবসাইট এমন কি এদের একটা নিজস্ব ছোটখাটো টেলিফোন এক্সচেঞ্জও ছিল।
কীভাবে চক্রটি কাজ করত
কভিথা দারা বলছিলেন, "নারীদের নির্দিষ্ট করার পরে চক্রের মাথারা তাদের খুব সন্তর্পণে বেছে নেওয়া খরিদ্দারদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া হত নারীদের ছবি। চক্রের একেকজন সদস্য মোটামুটিভাবে ৩০০ থেকে ৪০০ খরিদ্দারকে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটা বানাতো।
কোনও নারীকে খরিদ্দারের পছন্দ হলে তার কাছে ওই নারীর যাতায়াত, থাকার বন্দোবস্ত সব করে দিত চক্রেরই অন্য কেউ।"
যৌন কর্মের জন্য বিভিন্ন হোটেল, লজ ইত্যাদি ব্যবহার করা হত। আবার যৌন কর্মীদের এক জায়গা থেকে অন্য শহরে বিমানেও পাঠানো হত।
এই চক্রের মধ্যে ঋষি নামে একজনের আবার দায়িত্ব ছিল বিদেশ থেকে নারীদের নিয়ে আসার।
পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশের পাচার হওয়া বহু নারী এই চক্রে
বাংলাদেশ, নেপাল, থাইল্যান্ড এমনকি রাশিয়া আর উজবেকিস্তান থেকেও নারীদের নিয়ে আসা হত খরিদ্দারকে সন্তুষ্ট করার জন্য।
তবে যে ১৪ হাজারেরও বেশি নারী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের প্রায় অর্ধেকই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা।
এরপরে অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্য থেকেও নারীদের আনা হত।
বাংলাদেশি নারীদের সংখ্যাটা প্রায় শ চারেক বলে মনে করছেন মিজ দারা।
তবে এই ১৪ হাজার নারীকেই যে উদ্ধার করা গেছে, তা নয়।
উদ্ধার না হওয়া নারীদের নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ
যে ১৩০ জনকে সরাসরি উদ্ধার করা গেছে, তাদের আদালতে হাজির করিয়ে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
কিন্তু সাইবারাবাদ পুলিশের কাছে এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ উদ্ধার না হওয়া নারীদের তথ্য যোগাড় করে তাদের নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করা।
সেজন্য তারা বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশকে চিঠি দিচ্ছেন।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নারী পাচার রোধে কাজ করে, এমন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শক্তি বাহিনীর প্রধান ঋষিকান্ত বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন এই কাজ শুধু রাজ্য পুলিশ দিয়ে হবে না।
প্রয়োজন এন আই এ তদন্ত
মি. ঋষিকান্তের কথায়, "এই ঘটনায় আবারও সামনে এল যে বাংলাদেশ থেকে নারীদের পাচার করে ভারতে নিয়ে এসে যৌন পেশায় নামানো হচ্ছে। এটা তদন্ত করে দেখা দরকার যে সীমান্তের দুইদিকেই কারা এই নারীদের পাচার করাচ্ছে।"
তিনি মনে করেন, এত বড় চক্র সামনে আসার পরে বিষয়টি সন্ত্রাস দমনের কাজ করে যে জাতীয় তদন্ত এজেন্সি বা এন আই এ, তাদের হাতে এই তদন্ত প্রক্রিয়া তুলে দেওয়া উচিত।
"সাইবারাবাদ পুলিশ খুবই ভাল কাজ করেছে, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এত বড় একটা আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্জাতিক চক্র সমূলে উৎপাটিত করতে হলে ছড়িয়ে থাকা আড়কাঠি, দালাল এদেরও যেমন চিহ্নিত করতে হবে, তেমনই চক্রের সঙ্গে যুক্ত নারীদেরও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এন আই এ-র মতো সংস্থাকেই দায়িত্ব দেওয়া উচিত," বলছিলেন শক্তি বাহিনীর প্রধান ঋষিকান্ত।
ভারতে নারী পাচার বা যৌনকর্মের চক্র ফাঁস হওয়া নতুন কিছু নয়।
তবে এই চক্র যেভাবে বহু বছর ধরে একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সুচারুভাবে যৌন ব্যবসা চালাচ্ছিল এবং যত জন নারীকে এই চক্রে যুক্ত করেছিল - সেরকমটা আগে কখনও সামনে আসে নি।