ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতি দেশের আইনি ইতিহাসে কালো দাগ সৃষ্টি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও অশালীন আচরণের ঘটনার তিন আইনজীবী তলবে হাজির হলে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিল সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ মঙ্গলবার এই মন্তব্য করেন। খবর বাসসের।
আদালতে তিন আইনজীবীর পক্ষে ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা।
আদালতে মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিষয়টির শান্তিপূর্ণ ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। আজ থেকে সব কোর্ট চলছে। আমাদের আরো কিছু কাজ আছে। সবকিছুর সমাধান হবে আমাদের এক মাস সময় দেন।”
এ সময় আদালত বলেন, “কিছুই হয়নি। হাইকোর্টে এটার তারিখের আগে ওখানে একটু নাড়াচাড়া করেন। আমরা বুঝি। দিন যাচ্ছে আর টাইম নষ্ট করছেন। এটার (কনসিকুয়েন্স ফেস) পরিণতি ভোগ করতে হবে। আপনারা (রুলের) জবাব দিলে দেন, না দিলে না দেন। আমরা আমাদের মতো আগাবো। একটা কোর্টকে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে অচল করে রেখেছেন। সমস্ত কিছু আমরা দেখছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বার (আইনজীবী সমিতি) বাংলাদেশের লিগ্যাল ইতিহাসে কালো দাগ সৃষ্টি করেছে, সমস্ত আইনজীবীদের কলঙ্কিত করেছে।”
আদালত বলেন, “আইনজীবী সমিতির প্রেসিডেন্ট হোক আর সদস্য হোক, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। বার কাউন্সিল আছে। তবে বার কাউন্সিল কিছু না করলে আমরা এখান থেকেই করবো। প্রতিদিন আমরা খবরের কাগজে চোখ রাখি যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারে কি হচ্ছে। আপনারা কোর্ট বর্জন করছেন করেন, কিন্তু বিচার প্রার্থীরা কোর্টে গেলে তাদের ডিস্টার্ব করা হচ্ছে থ্রেট দেয়া হচ্ছে। আপনারা একতরফা (এক্সপার্টি) গেলে আমরা (এক্সট্রিম) এ যাবো। কে বারের সভাপতি, কে বিজ্ঞ আইনজীবী তা আমরা দেখবো না। এরা বাংলাদেশে প্রাকটিস (আইন পেশা পরিচালনা) করার যোগ্য কি না সেটাও আমরা দেখবো।”
পরে তিন আইনজীবীকে তাদের ব্যাখ্যা দিতে সময় দিয়ে এবিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন।
গত ২ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্টে রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবরে ‘এজলাসে আদালতের বিচারক ও কর্মচারীগণকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও অশালীন আচরণের জন্য আদালত অবমাননার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রার্থনা’ শীর্ষক একটি চিঠি পাঠান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের-১ বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুক। চিঠিটি প্রধান বিচারপতি বরাবরে উপস্থাপন করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। পরে বিষয়টি নিষ্পিত্তির জন্য প্রধান বিচারপতি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। সে অনুসারে এই বেঞ্চে নথি উপস্থাপন করা হয়। এরপর ৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট রুল জারি করে ১৭ জানুয়ারি তিন আইনজীবীকে তলব করেন। ১৭ জানুয়ারি হাজিরের পর সময় চেয়ে আবেদেনের পর তিন আইনজীবীকে ফের হাজির হতে বলে ১৪ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন। পাশাপাশি ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশ।
এ আদেশ অনুসারে আজ তিন আইনজীবী আজ হাজির হন। আর বিটিআরসি ৮ টি ফেসবুক ও ৫ টি ইউটিউব ভিডিও সরানোর কথা জানিয়েছে।
এদিকে গত ৫ ও ৮ জানুয়ারি এজলাস চলাকালে কয়েকজন আইনজীবী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা জজ শারমিন নিগারের বিরুদ্ধে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেন। এতে বিচারকাজ বিঘিœত হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিকার চেয়ে জেলা সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়।
এরপর বিষয়টি প্রধান বিচারপতির কাছে উপস্থাপন করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সে অনুসারে বিষয়টি ১০ জানুয়ারি আদালতে ওঠে।
শুনানির পর জেলার আরও ২১ আইনজীবীকে ২৩ জানুয়ারি তলব করেন। ওইদিন ২১ আইনজীবী হাজির হলে সময় আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা দায়রা জজ শারমিন নিগার এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে বদলি এবং নাজিরের শাস্তির দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যরা দুই আদালত বর্জন করে আসছিলেন। গত বুধবার থেকে আইনজীবীরা জেলার সব আদালত বর্জন শুরু করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি নাজির মো. মুমিনুল ইসলামকে চাঁদপুরে বদলি করা হয়েছে। আর চাঁদপুর আদালতের নাজির মো.ছানাউল্যা তালুকদারকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলি করা হয়েছে ।
এদিকে রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সার্কিট হাউসে জেলা জজসহ একাধিক বিচারক, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আইনজীবীরা আদালতে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
পরদিন বৈঠক করে আইনজীবী সমিতি আজ মঙ্গলবার থেকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বাদ দিয়ে সব আদালতে ফেরার ঘোষণা দেন।