বলা হয়, পরাজিত দলের প্রতি এক ধরনের টান কাজ করে। সেটি সহানুভূতির টান। শুধু পরাজিত নয়, তিরস্কারের শিকার হওয়া কোনো ব্যক্তি বা দলের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। দুর্বলের প্রতি ভালো লাগা যাকে বলে। ফুটবলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের বাইরে গিয়ে জার্মানিকে সাপোর্ট করার পেছনে আমার গল্পটাও দুর্বলের প্রতি ভালো লাগার মতোই।
সময়টা ২০০২ সাল, চলছে ব্রাজিল বনাম জার্মানির ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের ফাইনাল। আমরা তখন সিলেটের লন্ডনি রোডের বাসিন্দা। ডিশ এন্টেনার যুগ, সিলেটের বাড়ি-বাড়ি তখনও টেলিভিশন সংযোগ ঘটেনি। একটি টেলিবভিশন সেটকে কেন্দ্র করেই আশে পাশের কয়েক বাড়ি মিলে খেলা দেখার ধুম লাগতো।
তো, সেবার আমাদের বাসায় এই মেলা বসলো। বরাবরের মতোই ব্রাজিল ভক্তদের আধিক্য বেশি। খেলা শুরুর আগেই ভক্তদের মতে ব্রাজিলের জয় অনেকটা নিশ্চিত, তাছাড়া জার্মানি খেলা পারে না, তাদের নেই কোনো স্টার প্লেয়ার, এই কথা সেই কথা, ভদ্র-অভদ্র ভাষায় চলতে থাকলো।
কথাগুলো আমার মনে দাগ কাটে। খেলা না বুঝলেও এভাবে ভৎসর্নার শিকার হতে দেখে জার্মান দলের প্রতি অবচেতন মনে ভালো লাগা শুরু হয়। ফাইনালে জার্মানি ২-০ তে হেরে যায় তবে লন্ডনি রোডে সেদিন ব্রাজিল ভক্তদের মাঝে একজন জার্মানি ভক্তের জন্ম হয়।
আমার মতো অনেকেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এই বাইনারি হিসেবের বাইরে ভিন্ন কোনো দলকে সাপোর্ট করে। কেউ ইংল্যান্ড, কেউ ফ্রান্স-স্পেন আবার কেউ জার্মানি। তারা কেন এই দলগুলোকে পছন্দ করে এ নিয়েই আজকের লেখা।
জেরিনের প্রিয় ফ্রান্স
১৯৯৮ সাল। সেবার বিশ্বকাপ আয়োজন করে ফ্রান্স এবং জিতেও যায়। জেরিন তখন ছোট্ট শিশু। নীল জার্সিতে জিনেদিন জিদানের জাদুকরী গোলে মন কাড়ে তার। সে স্মৃতি এখনো মনে আছে জেরিনের।
জেরিন মুনির
"রিকি মার্টিনের গান, আর ফ্রান্সের নান্দনিক খেলা সব মিলিয়ে ৯৮'য়ের বিশ্বকাপ আমি কখনোই ভুলবো না। তখন থেকে ফ্রান্স করি, বলতে গেলে ফ্রান্সের সাথে আমার শৈশবের নস্টালজিয়া মিশে আছে।"
ব্যতিক্রমী দল পছন্দ হয়ে বন্ধ মহলে ঠাট্টার শিকার হয়েছেন জেরিন। প্রতিউত্তরে এটুকুই বলেন, "শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা ফ্রান্সের একমাত্র ভক্ত।"
জেরিন মুনির বর্তমানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ'র শেষ সেমেস্টারে পড়াশোনা করছেন।
স্রোতের বিপরীতে জার্মানি
"গ্রামে বড় হয়েছি, রাত জেগে খেলা দেখার সুযোগ ছিল না। ২০১৪ সালের ফাইনাল দেখি আর্জেন্টাইন সাপোর্টারদের সাথে। আমি স্রোতের বিপরীতে চলা লোক, তাই জার্মানিকে সাপোর্ট করা শুরু করি।" জার্মানিকে সাপোর্ট করার নেপথ্যের গল্প বলছিলেন তারেক রহমান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
জার্মানির জার্সির পরে তারেক রহমান
জার্মান ফুটবলকে সাপোর্ট করায় বন্ধুদের খোঁচাও কম খেতে হয়নি তারেকের। "চলতি বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ হারার পর তো টিএসসিতে ব্রাজিল ফ্যানরা আমাকে তুলোধুনো করে ছেড়েছে। তবে গত ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখে কিছুটা হলেও শান্ত তারা।"
ইংলিশদের ভক্ত মাহির
জেরিনের ফ্রান্স ও তারেকের জার্মানির মতো ইংল্যান্ড দলের একনিষ্ঠ সমর্থক মো: মাহির হোসেন। তিনি বর্তমানে এডটকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের সাইট একুইজিশন ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগে কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত।
ফুটবলপ্রেমীরা 'বেন্ড ইট লাইক বেকহাম' কথাটির সাথে নিশ্চয়ই পরিচিত। বেকহামের সেই বিখ্যাত ফ্রি কিক যেটি গ্রিসের বিপক্ষে ২০০২ এর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে করেছিলেন। ৯০ মিনিট শেষে অতিরিক্ত সময়ের তিন মিনিটে ফ্রি কিকে নিশ্চিত হয় ইংলিশদের বিশ্বকাপ।
সেই ম্যাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয় ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, সেই সময়েই ঢাকার লালবাগে স্কুল পড়ুয়া মাহির প্রেমে পড়েন ডেভিড বেকহামের। আর এভাবেই শুরু হয় ইংলিশ ফুটবলের প্রতি তার ভালো লাগা।
মো: মাহির হোসেন
মাহির বলেন, "বেকহাম দিয়ে এই ভালো লাগা শুরু। এছাড়া বাবা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ দেখতেন। আমি বরাবরই গতিশীল ফুটবলের ফ্যান আর ইংলিশ প্লেয়াররা ফাস্ট খেলতো, তাই ইংল্যান্ড আমার পছন্দ।"
প্রিমিয়ার লিগের কথা উঠায় আর্সেনালের প্রসঙ্গ আসে। "প্রিমিয়ার লিগে আমি আর্সেনালকে সাপোর্ট করি। আর্সেনালের শিরোপা জেতা আর ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ দুটোই সমার্থক, হাতে এসেও আসে না।"
এ নিয়ে হাস্যরসের মুখোমুখি হতে হয় মাহিরের। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "ফুটবল নিয়ে কথা হলেই বলে, তুমি তো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা করো না, অতএব তুমি তর্কে এসো না।
গত বিশ্বকাপ আসরে সেমিতে গিয়েছিল মাহিরের দল, ইউরোতে হয় রানার আপ। বন্ধুরা খোঁচা মেরে বলে "ইটস কামিং হোম।" মাহির হেঁসেই জবাব দেন "ইয়েস, ইট উইল কাম হোম (হ্যাঁ শিরোপা ঘরে আসবে)।"
দেশজুড়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার দ্বৈরথ চোখে পড়ার মতো। দু'দলের ভক্তদের আবেগ দেখলে মনে হতে পারে ফুটবল খেলে এই দুই দল, বাকি দলগুলো শুধু বল নিয়ে দৌড়ায়। তবে এমনই যদি হতো তাহলে জিদানের জাদুতে মুগ্ধ হতো না জেরিনরা, গোৎজের গোলের অপেক্ষায় রাত জেগে বসে থাকতো না তারেক আর বেকহামের ফ্রি কিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে থাকতো না মাহির।
মো: ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত