ঋণের স্বল্প সুদহারসহ তিন কারণে ব্যাংকিং খাতে এক বছরে তারল্য কমেছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা; আগের বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ২০২২ সালের একই সময়ে কমার এ হার ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
মঙ্গলবার ব্যাংকিং খাতে তারল্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, ঋণের প্রকৃত সুদহার কমে যাওয়া, করোনাভাইরাস মহামারীর বিধিনিষেধ কমে এলে অর্থনীতির জোরালো কর্মকাণ্ডে ঋণ বাড়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার কেনার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় থাকা তারল্য বা নগদ টাকার পরিমাণ কমে এসেছে।
সবশেষ হালনাগাদ এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই সময়ে যা ছিল ৪৩ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ২৮ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা; শতকরা হিসাবে ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
এর তিন মাস আগে জুন শেষে এ অঙ্ক ছিল ৪৩ হাজার ১৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে তারল্যের পরিমাণ কমেছে ১ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রবাহ ব্যাংকের বর্তমান তারল্য ব্যবস্থায় আরও চাপ তৈরি করেছে। সম্প্রতি ব্যাংক দেউলিয়া যাবে এমন গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হিড়িক পড়ে। এ নিয়ে কথা বলতে হয় সরকারপ্রধানকেও। এ গুজবে কান দিতে তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশসহ শরিয়াহভিত্তিক আরও কয়েকটি ইসলামি ব্যাংকে বড় ঋণ বিতরণের অনিয়মের খবর সংবাদ মাধ্যমে এলে সেগুলো থেকেও টাকা তোলার লাইন পড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তারল্যে টান পড়লে সাত ইসলামি ব্যাংক টাকা ধার নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
তবে সার্বিক তারল্য কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের সদুহার কমে যাওয়ার প্রভাবের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা মেনে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতের সুদহারও প্রথমে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সুদহার কমে আসার কারণে এরপর থেকে ঋণের চাহিদা বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটি ভূমিকা রাখে। এর সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের উচ্চমূল্য যোগ হলে গত অগাস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৫২ শতাংশে উঠে- যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এমন প্রেক্ষাপটে আগে থেকে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মুদ্রা সরবরাহ আরও কমিয়ে আনার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে গত জুনে রেপো সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০৯২২-২৩ অর্থবছরের নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
এসব পদক্ষেপের মধ্যেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে; ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য কমার ক্ষেত্রে এটিকে বড় কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা।
ব্যাংকিং খাতে তারল্য প্রবাহ কমে যেতে পারে বলে আগে থেকেই বলে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
মঙ্গলবার গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মানুষ ব্যাংকে সঞ্চয় করে সুদ পেত। মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় যা এখন অনেক কম, বলা যায় ‘প্রকৃত সুদহার ঋণাত্বক’ হয়ে গিয়েছে ব্যাংকে। সুদ না পেলে মানুষ অন্য কোথাও অর্থ খরচ করবে। এতে ব্যাংকেও তারল্য সংকট তৈরি হবে।
ব্যাংকে অর্থ ফিরিয়ে আনতে আমানতে সুদহার বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদন বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে গিয়েছে দুই লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা, যা জুন শেষে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে যাওয়া এ পরিমাণ অর্থ এখন নগদ আকারে মানুষের হাতে আছে। অথচ দেশে অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থার পরিধি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ব্যাংকরা মানুষের নগদ অর্থের ব্যবহার কমবে বলে আশা করছিলেন।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের পাশাপাশি ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে।
গত সেপ্টেম্বর শেষে অভ্যন্তরীণ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। তিন মাস আগে জুনে যা ছিল ১৬ লাখ ৭১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি ও রেমিটেন্সের পরিমাণ কম হওয়ায় সার্বিক লেনদেনে ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় বেড়েছে। এটি টাকার বিনিময় হারে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বড় অঙ্কের আমদানি দায় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকে সংরক্ষিত রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করায় বিদেশি মুদ্রার মজুদ গত ১৪ ডিসেম্বরের হিসাবে ৩৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে, সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৩৬ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলর।