বাংলাদেশের ‘উদার’ নীতি এবং সরকারের দেওয়া সুযোগ সুবিধার কথা তুলে ধরে অবকাঠামো, শিল্প, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ করতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতাকে কেবল বাণিজ্যের মধ্যে না রেখে, বৃহত্তর লাভের জন্য বিনিয়োগ, অর্থায়ন, সেবা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের মত ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিস্তৃতি ঘটানো উচিত। আর বিষয়টি দেখতে হবে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রেক্ষাপট থেকে।”
বুধবার দিল্লিতে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই) এবং কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) আয়োজিত বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ফোরামে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
গত এ যুগে বাংলাদেশের অগ্রগতির চিত্র ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সামনে তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাব, আপানারা বাংলাদেশের অবকাঠামো প্রকল্প, শিল্পোৎপাদন, জ্বালানি এবং পরিবহন খাতে বিনিয়োগের কতা বিবেচনা করতে পারেন।
“ভারতীয় বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাই-ব্যাক কাঠামোর আওতায় কম সময়ে, সাশ্রয়ী ব্যয়ে এবং স্বল্প সম্পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন করতে পারেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, গত দশ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের দিকেই অনেকটা ঝুঁকে আছে।
“বাংলাদেশ এখন উন্নত উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দামে মানসম্পন্ন পণ্য রতের বাজারে সরবরাহ করতে প্রস্তুত। তাই আমরা ভারতীয় আমদানিকারকদের আমন্ত্রণ জানাতে চাই, বহু দূরের দেশ থেকে বেশি দামে আমদানির বদলে বাংলাদেশি পণ্যের দিকে আপনারা নজর দিতে পারেন।”
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ১৩৭০.৩৫৭ মিলিয়ন ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে, যার মধ্যে ভারত থেকে এসেছে ১৫.৭৫১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, অর্থাৎ মোট এফডিআইয়ের মাত্র ১.১৫ শতাংশ ।
“দ্বিমুখী বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে আমরা কীভাবে আরও সুফল পেতে পারি, সেই পথ খুঁজে বের করতে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বাণিজ্য সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করে আমাদের দুই দেশের সহযোগিতা আরও জোরদার করা প্রয়োজনীয়তা আমরা এখানে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, এ অঞ্চলের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ সুবিধা বাংলাদেশই দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য আছে আকর্ষণীয় প্রণোদনা নীতি। এ খাতের উন্নয়নে ধারাবাহিক সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
শিল্প, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি এবং পণ্যের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তরান্বিত করতে সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং ২৮টি হাই-টেক পার্ক স্থাপন করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য মোংলা এবং মিরসরাইয়ে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে। আমি আজ এখানে উপস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেখানে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানাব।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা তাদের পণ্য কেবল ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে নয়, নেপাল, ভুটান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতেও রপ্তানি করতে পারবেন।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির চলমান সঙ্কটের কথাও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, এই সঙ্কট পণ্য পরিবহন ব্যবস্থাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ অনেক দেশই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।
“তবে এটা আনন্দের বিষয় যে চলমান চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম। অনেক বিশেষজ্ঞ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতি ভারত ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে উঠতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশও একটি সার্বভৌম, স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে ‘অনেক দূর’ এগিয়েছে।
“দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য-সহায়তার ওপর নির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এখন চাল, শাকসবজি, শস্য ও মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বের বড় উৎপাদক দেশগুলোর অন্যতম।”
অতীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার বাংলাদেশ এখন দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থাপনায় বিশ্বব্যাপী ‘উদাহরণ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখনই সবচেয়ে ‘ভালো’ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সম্পর্ক এখন প্রতিবেশীদের কূটনীতির ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
“বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন এবং বাণিজ্য অংশীদার। বাংলাদেশ থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পর্যটক ও চিকিৎসার জন্য রোগী আসে।
“হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক এখন বাংলাদেশে কাজ করছে। তারা উভয় দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান বন্ধুত্বের গভীর বন্ধন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে এবং বিকাশিত হবে। সেজন্য দুই দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উচিত আরও কাছাকাছি আসা এবং আমাদের জনগণের পারস্পরিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করা। এর মধ্য দিয়ে আমরা এ অঞ্চলে সমৃদ্ধি ও শান্তি আনতে সক্ষম হব।”