Loading...
The Financial Express

বিশ্বকাপ: মানবাধিকার না ব্র্যান্ড-মুনাফা?

| Updated: December 19, 2022 21:03:25


বিশ্বকাপের পুরোটা সময় কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড, অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা আর নারী ও এলজিবিটিকিউ অধিকারের প্রশ্নগুলো ঘুর ফিরে এসেছে। বিশ্বকাপের পুরোটা সময় কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড, অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা আর নারী ও এলজিবিটিকিউ অধিকারের প্রশ্নগুলো ঘুর ফিরে এসেছে।

বিশ্বের কয়েকশ কোটি চোখ যখন পুরো একটি মাস ফুটবল স্টেডিয়ামে নিবদ্ধ থাকে, নামিদামি খেলোয়াড়দের পেছনে, যানে, বাঁয়ে, গায়ে লেগে থাকে, ভেসে থাকে বড় বড় কোম্পানির নাম… বাডওয়াইজার, ভিজা, কোকা-কোলা, কাতার এয়ারওয়েজ, অ্যাডিডাস, ম্যাকডনাল্ডস, ওয়ান্ডা, ভিভো, হুন্দাই কিয়া এবং আরও অনেক।

সিএনএন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, সদ্য শেষ হওয়া কাতার বিশ্বকাপ এ দিক দিয়ে ছিল একটু অন্যরকম।

এই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে, বিশেষ করে যেগুলোর গোড়াপত্তন হয়েছে পশ্চিমের মাটিতে, তাদের এবার জটিল এক ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এক দিকে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সমালোচিত আয়োজক দেশ কাতার– দুই দিকেই সমালোচনা আর পৃষ্ঠপোষকতার ভারসাম্য রক্ষার খেলায় তাদের নামতে হয়েছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। 

অবশ্য তাতে ফিফার মূল লক্ষ্য পূরণে কোনো সমস্যা হয়নি। ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো গত শুক্রবারই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কাতার বিশ্বকাপের বাণিজ্যিক ও বিজ্ঞাপনী চুক্তিগুলো থেকে তারা রেকর্ড সাড়ে সাতশো কোটি ডলার আয় করেছেন, যা আগের আসরের চেয়ে ১০০ কোটি ডলার বেশি।

ফিফার বিশ্বকাপ আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকদের অধিকাংশই বিতর্কের মধ্যে চুপ ছিল।


আর ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে বিশ্বকাপের পরবর্তী যে আসর বসতে যাচ্ছে, সেখানে এই মুনাফার অংক ১১ শ কোটি ডলার ছাড়া বলে আশা করছে ফিফা।

কেবল আন্তর্জাতিক এই কোম্পানিগু নয়, টিম কাইহিল, কাফু, স্যামুয়েল ইতো ও শাভির মত সাবেক ফুটবল তারাকাদের মধ্যে যারা এ টুর্নামেন্টের প্রচারদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন, তাদেরও সমালোচনার মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়েছে।

বিশেষ করে আলোচনায় ছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ডেভিড বেকএম। যে টুর্নামেন্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এত অভিযোগ, সেই ক্রীড়া আসরের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হওয়ায় তাকে সমালোচনায় পড়তে হয়েছে, যা কি না তার নিজের ব্র্যান্ডকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

বেকএম এক দিকে কাতারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, আবার তিনি অ্যাডিডাস ও ঘরির ব্র্যান্ড টিউডরেররও প্রচার দূত। তার নিজের উইস্কি ব্র্যান্ড হেইড ক্লাব আছে, ‘ইন্টার মিয়ামি’ নামে একটি ফুটবল ক্লাবেরও অন্যতম মালিক তিনি।

ফ্রান্সের স্কেমা বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক সিমন চ্যাডউইক বলছেন, যখনই কোনো বাণিজ্য সম্পর্কে কেউ যায়, বিশেষ করে সেটা যদি স্পন্সরশিপ, এনডোর্সমেন্ট বা অ্যাম্বাসেডরশিপের মত কিছু হয়, তখন এক ধরনের ভূরাজনৈতিক জটিলতার ঝুঁকি থাকেই।

কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত যখন হল, তখন থেকেই চলছে নানামুখি সমালোচনা। দেশটির মানবাধিকার রেকর্ড, অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা আর নারী ও এলজিবিটিকিউ অধিকারের প্রশ্নগুলো পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ঘুর ফিরে এসেছে। কয়েকজন শো বিজ তারকা কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনে যোগ দিতে অস্বীকার করেছেন। এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের সমর্থনে এবং কাতারের অবস্থানের সমালোচনায় জার্মান ফুটবল দল তাদের প্রথম ম্যাচে প্রতিবাদ জানিয়েছে মুখ ঢেকে রেখে।

ফিফা তিনটি ক্যাটাগরিতে টুর্নামেন্ট স্পনসরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।

ফিফা আর কাতারের দিকে অভিযোগ আর সমালোচনার তীর এসেছে পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকা থেকেই বেশি। এসব এলাকার কোম্পানিগুলো থেকে ফিফার স্পন্সরশিপের টাকার একটি অংশ মাত্র আসে।

ওইসব দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে অ্যাডিডাস বা ম্যাকডনাল্ডসের ব্যবসা ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়ে। আবার মানবাধিকার নিয়ে মুখ খোলার স্বাধীনতা সব দেশে সমান নয়। আর সমালোচনা যতই হোক, শেষ পর্যন্ত তা খেলাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

ফিফা জানিয়েছে, রেকর্ড সংখ্যক দর্শক টেলিভিশনে কাতার বিশ্বকাপ দেখছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে আর্জেন্টিনার পরাজয়, মেসির হাতে কাপ দেখার আকুতি, মরক্কোর ঐতিহাসিক সেমি ফাইনাল, সবকিছুই দর্শকরা উপভোগ করছেন।

অধ্যাপক সিমন চ্যাডউইক বলছেন, সব কিছুর পর এখানে ফুটবলটাই ছিল আসল। সে কারণেই ভারসাম্য রাখতে গিয়ে স্পন্সর কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় টান পড়েনি।

অ্যাডিডাসের একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন, এ বিশ্বকাপের মৌসুমেই ৪২১ মিলিয়ন ডলারের বিক্রির প্রত্যাশা করছেন তারা। ম্যাকডোনাল্ডস বিশ্বকাপ ঘিরে তাদের সবথেকে বড় ’গ্লোবাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন’ করেছে।

বিশ্বকাপ শুরুর দিনই ফিফা তাদের সব ধাপের স্পন্সরশিপ বিক্রি হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। টুর্নামেন্টের দুই ‍দিন আগে কাতারের স্টেডিয়ামের ভেতর অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করার মত সিদ্ধান্ত যখন এল, বাডওয়াইজার ছাড়া বাকি সব কোম্পানিই ছিল ‘চুপ’।

গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১০ সালে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত বছর পর্যন্ত সাড়ে ছয় হাজার দক্ষিণ এশীয় শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে সেখানে, যাদের বেশিরভাগই কম মজুরির, বিপদজনক কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং প্রায়ই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তাদের কাজ করতে হত।

অবশ্য সব মৃত্যুই বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে সংশ্লিষ্ট বলে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি এবং সিএনএনও নিরপেক্ষভাবে সেসব মৃত্যুর তথ্য যাচাই করতে পারেনি বলে জানিয়েছে।

কাতারে নারী ও এলজিবিটিকিউ অধিকারের প্রশ্নগুলো বিশ্বকাপের পুরোটা সময় ঘুর ফিরে এসেছে।


শুরুর সেই বিতর্ক স্তিমিত হওয়ার আগেই নতুন করে সমালোচনা শুরু হয় কাতারের মানবাধিকার রেকর্ড, অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বাজে আচরণ এবং দেশটির আইনে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার মত বিষয়গুলো।

অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি কাতারের আচরণ নিয়ে অভিযোগগুলো বেশ গুরুতর আকার ধারণ করে। বিশ্বকাপের আগে আগে এবং উদ্বোধনের দিনেও এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম।

অ্যাডিডাস ও ম্যাকডনাল্ডসের মত পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলো বলেছে, ‘মানবাধিকারের বিষয়গুলো’ মেনে চলতে তারা ফিফা ও কাতার কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়ে আসছে। আর ফিফা তাদের ‘স্পন্সরশিপ’ পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল ২০১৫ সাল থেকেই

জেএমডব্লিউ সলিসিটরসের খেলাধুলা সেবার প্রধান বেন পেপ্পি বলেন, ২০১৫ সালে ফিফার দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পর অনেক কোম্পানি স্পন্সরশিপ চুক্তি বাতিল করে। তখন থেকেই ফিফা পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার বাইরের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধতে মনোযোগী হয়।

ফিফার শীর্ষ স্পনসরদের মধ্যে এখন আছে চীন ভিত্তিক ওয়ান্ডা, কাতার এয়ারওয়েজ এবং কাতার এনার্জির মত কোম্পানি, যাদের মানবাধিকার প্রশ্নে ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর মত অতটা সমস্যায় পড়তে হবে না।

চ্যাডউইক বলেন, কাতার এয়ারওয়েজ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি। স্বাভাবিকভাবেই তারা মানবাধিকার প্রশ্নে স্লোগান দিতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধে যাবে না।

আর টুর্নামেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা চার চীনা কোম্পানি ওয়ান্ডা, ভিভো, মেংনিউ ডেইরি ও হাইসেন্সেরও সমকামী অধিকার কিংবা মানবাধিকারের বিষয়গুলোর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জোরালো সম্ভাবনা নেই।

ফিফা সাধারণত তিনটি ক্যাটাগরিতে টুর্নামেন্ট স্পনসরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এর মধ্যে কোকা-কোলা, অ্যাডিডাস, ভিজা, ওয়ান্ডা, কাতার এয়ারওয়েজ, কাতার এনার্জি ও হুন্দাই কিয়া হল টুর্নামেন্টের ‘অংশীদার’। বাডওয়াইজার, ম্যাকডনাল্ডস, মেংনিউ ডেইরি এবং হাইসেন্স ‘বিশ্বকাপ স্পনসর’; এবং বাইরে আছে ‘আঞ্চলিক সহযোগীরা’

বেন পেপ্পি বলছেন, এসব পৃষ্ঠপোষকদের অধিকাংশই বিতর্কের মধ্যে চুপচাপ ছিল। মানবাধিকার সংক্রান্ত সমস্যাগুলো আমলে নিয়েছে কয়েকটি মাত্র ব্র্যান্ড।

ডেনমার্কের কিট প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘হামেল’ তাদের দলকে ‘টোনড ডাউন’ কিট সরবরাহ করেছিল। পরে ফিফা ডেনমার্ককে জানিয়ে দেয়, ওই কিট বিশ্বকাপে ব্যবহার করা যাবে না।

ফিফা যখন ঘোষণা দিল যে বিশ্বকাপের মাঠে ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড পর নামলে খেলোয়াড়দের শাস্তির মুখে পড়তে হবে, জার্মান সুপার মার্কেট চেইন রেভে তখন দেশটির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের অবসান ঘটায়, কারণ ওয়ানলাভ আর্মব্যান্ডকে এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

সিএনএন লিখেছে, এই উদাহরণগুলো বাদ দিলে টুর্নামেন্ট স্পনসরদের বেশিরভাগই সমালোচনার মধ্যে নীরব ছিল।

গত জুলাইয়ে তিনটি মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রা্ইটস ওয়াচ ও ফেয়ার স্কোয়ার কাতারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে ফিফার ১৪টি কর্পোরেট অংশীদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

কাতার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অধিকাংশ অভিযোগ অস্বীকার করে এলেও বিশ্বকাপ আয়োজনে ৪০০ থেকে ৫০০ শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি স্বীকার করেছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাডওয়াইজার, অ্যাডিডাস, কোকা-কোলা ও ম্যাকডনাল্ডস কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের কাজে থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কথা বলেছে। যারা সেখানে মারা গেছে, মজুরি বঞ্চিত হয়েছে কিংবা অবৈধ নিয়োগের কারণে ঋণের দায়ে পড়েছে, তাদেরকেই দেওয়া হয়েছে ওই ক্ষতিপূরণ। কিন্তু বাকি দশটি কোম্পানি অ্যামনেস্টির লিখিত অনুরোধের কোনো জবাব দেয়নি।

ফ্রি কিক থেকে বেকএম এর বাঁকানো শটের গোল তাকে এতটাই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল যে ২০০২ সালে ‘বেন্ড ইট লাইক বেকএম’ নামে একটি সেনামও হয়। খেলার সময় থেকেই তিনি নিজেকে পরিণত করেছেন একজন ক্রীড়া উদ্যোক্তার ব্র্যান্ড হিসেবে।

চ্যাডইউকের মতে, চলতি শতকের শুরুতে যখন ব্যক্তি কেন্দ্রিক ক্রীড়া ব্যান্ডিংয়ের প্রসার শুরু হল, বেকএম তার প্রথম দিকের ফসল। এখন যেভাবে তিনি সমালোচনা গায়ে না মেখে ভারসাম্যের কৌশল মেনে ব্যবসা করে যাচ্ছেন, শুরুর দিকে এরকম করতে হলে তাকেও হয়ত ভাবতে হত।

বেকএমের মুখপাত্র সিএনএনকে বলেছেন, “একজন খেলোয়াড় এবং একজন প্রচারদূত হিসাবে ডেভিড বেশ কয়েকটি বিশ্বকাপ এবং অন্যান্য বড় আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আসরে যুক্ত ছিলেন। তিনি সবসময় এটাই বিশ্বাস করেন যে, খেলাধুলার যে শক্তি, তা বিশ্বের ভালোর জন্য ব্যবহার করা যায়।

“আমাদের বিশ্বাস, এইসব আলোচনা আমাদের বোঝাপড়ার জায়গাটা আরও স্পষ্ট করবে এবং সবার মঙ্গলের জন্য এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য পূরণ সহজ করবে।”

Share if you like

Filter By Topic