একটা সময় ছিলো যখন বলিউডে হরর মুভি মানে তা ছিলো শিশুদের জন্য নিষিদ্ধ। অবশ্য শুধু শিশুরাই নয়, বড়দের অনেকেও হরর সিনেমা দেখতে চাইতেন না এর ভেতরে থাকা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপারগুলোর কারণে। সে সময় রামসে ব্রাদার্স এর কাজগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তবে সেগুলো ছিলো প্রাপ্তবয়স্ক বা অন্তত কিশোর-তরুণদের জন্য।
আজ থেকে বিশ বছর আগে ২০০২ সালে মুক্তি পেয়েছিলো মাকড়ি। সে সময়ের হরর চলচ্চিত্রের ধারায় একেবারেই নতুন সংযোজন। শিশুদের উপযোগী হরর চলচ্চিত্র! এই ছবিটি দিয়েই পরিচালক হিসেবে অভিষেক হয় বিশাল ভরদ্বাজের। এর আগে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি পেলেও এই সিনেমা তাকে পরিচালক হিসেবেও খ্যাতি এনে দেয়।
মাকড়ি অর্থ মূলত মাকড়সা। এই সিনেমার গল্পটি দুই জমজ বোন চুন্নি আর মুন্নির। দুষ্টু চুন্নি আর শান্ত মুন্নির ভেতর খিটমিট লেগেই থাকতো।
সেই গ্রামে ছিলো একটা পোড়োবাড়ি। গ্রামবাসী বিশ্বাস করতেন সেখানে বাস করে এক ডাইনি বা চূড়েল। চূড়েল এক ধরণের প্রেতাত্মা যার পা থাকে উলটো দিকে। তবে এই প্রেতাত্মা আবার অত নৃশংস নয়, সে নিজ ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন জীব বানিয়ে দেয়। এই ডাইনিরই নাম মাকড়ি। মাকড়সা যেমন জাল বিস্তার করে শিকার ধরে, তেমনি মাকড়ির সেই পোড়োবাড়িতে ঢুকলে সবাই জীবজন্তু হয়ে বেরিয়ে আসে এমনটাই ছিলো গ্রামবাসীর বিশ্বাস।
কসাই কাল্লু এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র। কসাই হলেও সে নির্দয় নয়, বরং ভীষণ ফূর্তিবাজ। এই দুইবোনের সাথেই তার খুব সখ্য।
তবে একদিন কসাই মজাচ্ছ্বলে তাড়া দিলে একবোন ঢুকে পড়ে সেই বাড়িতে। তারপর আরেক বোন শুরু করে তার খোঁজ।
এরপরের ঘটনা সিনেমাটি দেখলেই জানা যাবে। তবে বিশাল ভরদ্বাজের এই সিনেমাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দিক থেকে।
পাংগা, মাই কিংবা মাকড়ি থিম টা তো আছেই, তার সঙ্গীত পরিচালনা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে এই সিনেমায় নিছক ভয় পাওয়ানোকে তিনি হাতিয়ার করেননি। হরর সিনেমায় যৌনতা ও সহিংসতার যে মেলবন্ধন ঘটে, তা তিনি এখানে আরোপ করেননি।
ডাইনি মাকড়ির চরিত্রে শাবানা আজমির মেকআপ যেমন ভীতি জাগানিয়া, তেমনি কাজ-কর্ম আবার কিছুটা ডার্ক কমেডিসদৃশ। তবে তাতে করে ভীতিভাব কমেনা।
মুন্নি ও চুন্নির চরিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে অসাধারণ অভিনয় করেছেন শ্বেতা বসু প্রসাদ। চুন্নি নামের মেয়েটি খুব দুষ্টু। বোন মুন্নিকে নানারকম জ্বালাতন করে। তবে বিপদে পড়লে মুন্নিকে উদ্ধারে কীভাবে এই দূরন্ত মেয়েটিই সাহায্য করতে এগিয়ে যায় তা এখানে মূল উপজীব্য।
আবার, গল্পটি শুধু ভয়ের হয়ে থাকেনি। সেই ডাইনীরূপী নারীর এই কার্যকলাপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য স্বার্থ ও এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও কাহিনীর শেষে উপস্থিত থাকে। এছাড়া আছে এর সাথে যুক্ত থাকা প্রশাসনিক বিষয় তথা রক্ষকদের ভক্ষক হয়ে ওঠার বিষয়টিও।
এটি ছিলো বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র, ছবি: দি হলিউড রিপোর্টার
কাল্লুর চরিত্রে মারকান্দ দেশপান্ডেও দারুণ সাবলীল অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্রটিকে কেউ একেবারে পুরো ভালো বা পুরো খারাপ বলতে পারেনা। চুন্নির সাথে এর একটা খটমট বেধে থাকতো, কিন্তু মুন্নিকে উদ্ধারের জন্য সেও এগিয়ে আসে।
আবার, চুন্নির স্কুল শিক্ষক যখন বাড়িটিতে এসে সব ফাঁকা দেখেন, তখন চুন্নি ও মুন্নির বন্ধু মুঘল-ই-আজম এর কুকুরকে এই বাড়িতে খুঁজে পাওয়া একেবারেই ভিন্ন একটি সম্ভাবনা তৈরি করে ও কাহিনীটির গতিপথ ভিন্ন দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
এই সিনেমায় বিভিন্ন মানুষকে ডাইনীর পশুপাখি বানিয়ে দেয়া একদিকে যেমন ভয়ের ভেতরও হাসির উপলক্ষ আনে, আবার এর ভেতর আছে চিন্তার উদ্রেককারী উপাদানও। পশুপাখিগুলো ডাইনির নিয়ন্ত্রণাধীন, মানুষ তা নয়। কিন্তু মানুষকে পশুপাখি বানিয়ে দেয়া প্রতীকী অর্থে মানুষকে নিয়ন্ত্রণাধীন করা ও বিচার-বিবেচনার লোপ ঘটানোকে বোঝানো যায়।
এখানে পরিবেশ পরিস্থিতির সাপেক্ষে শিশুদের সাহসী হয়ে ওঠার ব্যাপারটিও এসেছে। বোন নিখোঁজ হবার আগ পর্যন্ত চুন্নির জীবনে সুখের বাইরে দুঃখের কিছু ছিলো না। কিন্তু তার একটি দুষ্টুমির ফলে কসাই কাল্লুর সাথে ভুল বোঝাবুঝিবশত মুন্নি বিপদে পড়ে। এ সময়ে চুন্নির ভেতর বেশ অনুতাপবোধ ও কাজের ফল ভেবে কাজ করার একটি প্রবণতা তৈরি হতে দেখা যায়।
দুরন্ত একটি মেয়ে চুন্নি তার বোনকে উদ্ধারের জন্য ডাইনীর দেয়া কঠিন শর্ত মেনে কাজ শুরু করে। এরপর তার সামনে অজানা চমকপ্রদ অনেক কিছু উন্মুক্ত হয়। সেই ব্যাপারগুলো থেকে একসময় পুরো ব্যাপারটির ভেতরের রহস্য বোঝা ও এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়াও চুন্নির পক্ষে সম্ভবপর হয়। এভাবে শিশুদের ভয় কাটিয়ে সমস্যা মোকাবিলা করতে পারার মতো শক্তি অর্জনের বিষয়েও সিনেমাটি আলোকপাত করেছে।
শিশুতোষ হরর হিসেবে মুক্তির বিশ বছর পরও তাই 'মাকড়ি' একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে। একদিকে ভয়ের শীতল স্রোত, আরেকদিকে যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করা। দুদিক থেকেই সফল মাকড়ি। মুক্তির বিশ বছর পর এখনো এ প্রজন্মের শিশু কিশোরদের এটি দিতে পারে ভীতিজাগানো শিহরণ ও সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তার খোরাক। তেমনি আবার সে সময়ের শিশু-কিশোর, যারা আজ যৌবনে উপনীত হয়েছে; তাদের জন্য নিয়ে আসতে পারে স্মৃতি রোমন্থন ও বিশ বছর আগের নস্টালজিয়ায় আবারো ডুবে যাওয়ার সুযোগ।
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।