বিবিসি বাংলা রেডিও: ৮১ বছরের এক সুদীর্ঘ যাত্রার ইতি


মোঃ সাজ্জাদ হোসেন   | Published: October 07, 2022 16:35:50


বিবিসি বাংলা রেডিও: ৮১ বছরের এক সুদীর্ঘ যাত্রার ইতি

দীর্ঘ ৮১ বছর পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিবিসি বাংলা রেডিও। এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটবে একটি যুগের। ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য বাংলাসহ বিশ্বের মোট ১০টি ভাষায় রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করছে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি)। বন্ধ হতে যাওয়া অন্য ৯ ভাষা হচ্ছে আরবি, ফারসি, চীনা, কিরগিজ, উজবেক, হিন্দি, ইন্দোনেশীয়, তামিল ও উর্দু।

বিবিসি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা। ওয়ার্ল্ড সার্ভিসকে আরো আধুনিক ও ডিজিটাল রূপদানে এই পরিকল্পনা সহায়তা করবে। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো ভাষা বিভাগই পুরোপুরি বন্ধ করা হচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি অনলাইনে কার্যক্রম চালাবে।  

বিবিসি বাংলার রেডিও কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর। বাংলায় ১৫ মিনিটের সাপ্তাহিক সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে এর প্রারম্ভ। ১৯৬৫ সালে বিবিসি বাংলায় সংবাদ প্রচার শুরু হয়। নিরপেক্ষ অনুষ্ঠান তথা সংবাদ পরিবেশনের কারণে à¦¬à¦¾à¦‚লাদেশ à¦“ à¦­à¦¾à¦°à¦¤à§‡à¦° প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ বাংলাভাষী শ্রোতার কাছে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

১৯৪১ সালে যাত্রা শুরুর সময় প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত হতো একটি মাত্র অনুষ্ঠান, যা ছিল মূলত একটি ‘নিউজলেটার’। অনুবাদ করে তা পড়তেন বিভিন্ন জন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে ভারত থেকে অনুষ্ঠান প্রযোজনার জন্য আসেন কমল বোস এবং রেখা আলী। তাদের পরিবেশনায় ভারতীয় বাংলাভাষী শ্রোতাদের জন্য শুরু হল ‘বিচিত্রা’ নামের একটি ম্যাগাজিন।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতাদের জন্যও তৈরি হলো ‘আঞ্জুমান’ নামে আলাদা একটি অনুষ্ঠান। সেটিও ছিল অনেকটা বিচিত্রা’র ঢঙে। সংবাদ সেখানে তেমন গুরুত্ব পেত না। অনুষ্ঠানটি প্রযোজনার জন্য নিয়ে আসা হল নাজির আহমেদকে।

১৯৬৫ সালে বিবিসি বাংলা’র সম্প্রচারে প্রথম যুক্ত হল মূলধারার সংবাদ। ওই বছরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাংলা অনুষ্ঠানের শ্রোতারা দাবি করলেন হিন্দি আর উর্দুর মতো বাংলাতেও প্রতিদিন বিবিসি থেকে তারা যুদ্ধের নির্ভরযোগ্য আর নিরপেক্ষ খবর চান। তাদের কথা ছিল, জাতীয় বেতারে তারা শুধু কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত খবরই পাচ্ছেন। এই দাবির মুখেই শুরু হল বিবিসি বাংলা রেডিওর সংবাদ পরিবেশন।

১৯৬৯ সালে বিবিসি তার দেশভিত্তিক সম্প্রচার নীতি পাল্টিয়ে চালু করল ভাষাভিত্তিক সম্প্রচার নীতি। শুরু হলো সম্মিলিত সম্প্রচার ও অনুষ্ঠানের পরিকল্পিত একটা কাঠামো গঠন করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বিবিসি বাংলার নাম ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন à¦¬à¦¿à¦¬à¦¿à¦¸à¦¿à¦° নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচারের কারণে এটি বিপুল বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিল। ঘরে ঘরে বিবিসি বাংলা রেডিওর সংবাদের জন্য মুখিয়ে থাকতেন শ্রোতারা।

প্রতিদিন সন্ধ্যায় অবরুদ্ধ ঢাকায় বিবিসিতেই প্রচার হতো  মুক্তিযুদ্ধের সকল খবর।পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে ভয়াবহ অত্যাচার–নিপীড়ন চালাচ্ছে, বিবিসির মাধ্যমেই তা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। নয়তো পশ্চিম পাকিস্তানিরা একে নিছক গৃহযুদ্ধ হিসেবেই প্রচার করছিল। শুধু বিশ্ববাসীই নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষও এই বিবিসি বাংলা রেডিও শুনেই মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর পেতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আর বিবিসি এই দুই-ই ছিল বাঙালির তথ্য পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসনামলের পুরো সময়টা বিবিসি বাংলাকে নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে দেখা হতো।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলা বিভাগের সম্প্রচারে ছিল কিছু সংবাদ আর নানা ধরনের বিনোদন অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ। বাংলা বিভাগের জন্য সংবাদ সংগ্রহের কোনো নেটওয়ার্ক সে সময় তৈরি হয়নি। আন্তর্জাতিক খবরগুলো মূলত অনুবাদ করে সম্প্রচারিত হতো। ঢাকা থেকে বিবিসি বাংলা’র জন্য খবর দিতেন আতাউস সামাদ।

নব্বইয়ের দশকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের তৎকালীন পরিচালক জন টুসা নির্দেশ দিলেন সব ভাষা বিভাগকে তাদের নিজস্ব সাংবাদিকতায় আরও প্রসারিত করতে। সৈয়দ মাহমুদ আলী তখন ছিলেন বাংলা বিভাগের প্রধান।

বতর্তমানে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ৩২৮টি পদ শূন্য করার মাধ্যমে দুই কোটি ৮৫ লাখ পাউন্ড সাশ্রয়ের প্রস্তাব রেখেছে। অন্যদিকে বছরে ৫০ কোটি পাউন্ড সাশ্রয়ে সিবিবিসি ও বিবিসি ফোরের কার্যক্রমকেও অনলাইনভিত্তিক করে তোলা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের রেডিও, টিভি ও ডিজিটাল কার্যক্রম রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষর কাছে পৌঁছায় বিবিসি। এখন এর অর্ধেকই অনলাইননির্ভর।

কিন্তু বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সমন্বিত চাপের ফলে বন্ধ করে দেওয়ার কঠিন এই সিদ্ধান্তের দিকে যেতে হচ্ছে। হয়তো সবকিছুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী এ সংবাদমাধ্যম। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে চিরকালের জন্য জড়িয়ে থাকবে বিবিসি বাংলার নাম।

 

মো: সাজ্জাদ হোসেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত।

sajjadhossain016016@gmail.com

 

Share if you like