রাশিয়ার যেসব জাহাজ মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে, সেসব নৌযানের বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার সাতটি কোম্পানির ৬৯টি মাদার ভেসেল বাংলাদেশের কোনো বন্দরে ভিড়তে পারবে না। পণ্য আমদানি, ফুয়েলিং (জ্বালানি সংগ্রহ), নোঙর বা এই পথ ব্যবহার করে অন্য কোথাও চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে আসা রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর’অনুমতি না পাওয়ায় পণ্য খালাস না করেই ভারতীয় জলসীমা থেকে ফিরে যায় গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ১৬ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা জারির সরকারি সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বন্দর ও শিপিং সার্ভিসকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
ইউক্রেইনে রুশ আক্রমণের জেরে রাশিয়ার উপর বেশি কিছু বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা। সেই তালিকায় রাশিয়ান ব্যাংক, জাহাজ ও পণ্য রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক লেনদেন যোগাযোগ পরিষেবা সুইফটও রাশিয়ার ব্যাংকের সঙ্গে সব ধরনের আর্থিক লেনদেন বন্ধ রেখেছে।
এর ফলে বাংলাদেশও এখন রাশিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন করতে পারছে না। অথচ অর্থিক বিবেচনায় দেশের সবচয়ে বড় মেগ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রাশিয়ার সহযোগিতাতেই নির্মাণ হচ্ছে।
সেই প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও রসদের বড় একটি অংশ রাশিয়া থেকে আসার কথা। এর অংশ হিসেবে যন্ত্রপাতির চালান নিয়ে জানুয়ারিতে এসেছিল ‘উরসা মেজর’। কিন্তু কূটনৈতিক চাপে জাহাজটি পণ্য খালাসের অনুমতি পায়নি।
পরে জাহাজটি ভারতের হলদিয়া বন্দরে খালাসের জন্য গেলে সেখানেও সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত মালামাল নিয়ে ফিরে যায় রাশিয়ার জাহাজটি।
এমন প্রেক্ষাপটে নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা রাশিয়ার জাহাজের ওপর বাংলাদেশের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানালেন নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের রেজিস্ট্রার অব বাংলাদেশ শিপস ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ।
তিনি বলেছেন, “রাশিয়ার যে ৬৯টি মাদার ভেসেলের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সেসব জাহাজের বাংলাদেশের বন্দরে ভেড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।”
গত ১৬ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা জারির ওই চিঠি রাষ্ট্রায়ত্ব শিপিং কর্পোরেশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা, নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর, কোস্টগার্ডসহ আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিষেবা সরবরাহকারীদের সংগঠনকেও জানিয়ে দেওয়া হয়।
যে ৬৯টি মাদার ভেসেলকে সমুদ্রসীমায় ভিড়তে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর পরিচিতি সনাক্তকরণ (জাহাজের আন্তর্জাতিক আইএমও) নম্বর উল্লেখ করে তালিকাও সরবরাহ করেছে নৌ-বাণিজ্য দপ্তর।
সেখানে তেল পরিবহনকারী অয়েল ট্যাংকার, সাধারণ পণ্যবাহী কার্গো ভেসেল, গাড়ি পরিবহনকারী রো রো ভেসেল, ড্রেজার, টাগসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির জাহাজ রয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ‘‘রাশিয়ার এ সকল জাহাজকে শুধু বন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাই নয়, এগুলোর নিবন্ধন, জাহাজের বাঙ্কারিং, শ্রেণিকরণ, সনদায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, পুণঃসরবরাহ, রিফুয়েলিং, বীমা এবং অন্যান্য সামুদ্রিক পরিষেবাও এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে।”
বাংলাদেশের জলসীমায় রাশিয়ার এসব জাহাজের কোনো ‘অস্তিত্ব দেখা গেলে’ বা কোনো তথ্য পাওয়া গেলে জরুরি ভিত্তিতে তা নৌ দপ্তরকে জানাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে।
সরকারের এমন সিদ্ধান্তে রাশিয়ার এসব জাহাজে করে অন্য যে কোনো দেশ থেকেও পণ্য আমদানি করতে পারবে না বাংলাদেশের কোনো আমদানিকারক বা শিপিং এজেন্ট।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাহাজ ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব জাহাজকে তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের।
চিঠি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন গভীর সমুদ্রে চলাচলকারী বাংলাদেশি জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশান গোয়িং শিপ ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরী।
তিনি বলেন, “রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞাটি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলে। এখন যদি এসব জাহাজ ব্যবহার করে কোনো পণ্য বাংলাদেশে আসে, তাহলে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে বাংলাদেশ। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সিংহভাগই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের।
“সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের রাশিয়ার জাহাজ ব্যবহার করা উচিত হবে না।”
‘প্রভাব পড়বে না’ পণ্য পরিবহনে
গভীর সমুদ্রে চলাচল করে এরকম জাহাজের সংখ্যা বাংলাদেশের ১৯৭টি। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে পরিমাণ পণ্য পরিবহন করে, তার ১০ শতাংশেরও কম এসব জাহাজের মাধ্যমে হয়।
আজম জে চৌধুরী বলেন, “আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহেনে দেশি-বিদেশি জাহাজ ব্যবহৃত হয়। রাশিয়ার জাহাজ নিয়ে একটু সতর্ক হলেই ভাড়া ও পণ্য পরিবহনে কোনো প্রভাব পড়বে না বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ওপর।”
বিদেশি জাহাজের বাংলাদেশি এজেন্ট ও বিদেশি জাহাজ ভাড়া নিয়ে পণ্য পরিবহনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনস (বিএসএএ) এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, অনেক এজেন্টের সঙ্গে রাশিয়ার জাহাজের দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি রয়েছে পণ্য পরিবহনে। এখন সেই চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করতে হবে নিষেধাজ্ঞার অবসান না হওয়া পর্যন্ত।
“এতে এজেন্ট ও জাহাজ মালিকদের আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হবে। বর্তমানে জাহাজ ভাড়াও কমছে। তাতে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে। আন্তর্জাতিক জাহাজের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনে সমস্যা হবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি বাণিজ্য হয়, তার শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় নেই রাশিয়া। আমদানি পণ্যর ৮৭ শতাংশই আসে শীর্ষ ওই ২০ দেশ থেকে।
আর রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই হয় শীর্ষ ১৫টি দেশের সঙ্গে। এই শর্ষ ১৫ দেশের তালিকাতেও রাশিয়া নেই।
রাশিয়া থেকে মূলত গম ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য বেশি আমদানি করে বাংলাদেশ। আর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক বেশি যায় রাশিয়ায়।