বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষা বাড়িয়েছে খরচের বোঝা: ইউনেসকো


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: November 02, 2022 10:06:47 | Updated: November 02, 2022 15:25:41


সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের শিক্ষার সবচেয়ে বেশি প্রসার হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে, বলছে ইউনেসকো।ফাইল ছবি

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান স্বীকার করলেও তার অন্য একটি অভিঘাত ধরা পড়েছে ইউনেসকোর গবেষণায়। à¦–বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

জাতিসংঘ সংস্থাটি বলেছে, বেসরকারি বিদ্যালয় ও পাঠদান প্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধি বাংলাদেশে পরিবারপিছু শিক্ষা খরচের বোঝা দিয়েছে বাড়িয়ে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো মঙ্গলবার প্যারিস ও ঢাকা থেকে একযোগে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ইউনেসকোর সংস্থার গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ও ব্র্যাক’র উদ্যোগে চালিত এই গবেষণায় সরকারের প্রতি বেসরকারি খাতে পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নজরদারি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে শিক্ষা নিয়ে বৈষম্য দূর হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পরিবারে প্রাইভেট পড়ানোতে খরচ ২০০০ সালের ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১০ সালে ৫৪ শতাংশ হয়েছে। শহরাঞ্চলে এই খরচ ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। যেখানে দেশের প্রাক প্রাথমিকেই ২০ শতাংশ শিশুর প্রাইভেট টিউটর রয়েছে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষা খাতে খরচ বাড়ার এই প্রবণতা উঠে এসেছে ইউনেসকোর এই জরিপে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ এর দশকে বাংলাদেশ সরকার বার্ষিক দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আড়াই শতাংশের কম খরচ করেছে শিক্ষা খাতে, যার পরিমাণ জাতিসংঘের সুপারিশ করা ৪ শতাংশ সীমার অনেক নিচে। আর এ কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

ফলে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হার বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খরচ করা অঞ্চল হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া, যেখানে শিক্ষা খাতের খরচের ৩৮ শতাংশের জোগান দেয় পরিবারগুলো। এরমধ্যে নেপালে এই খরচের হার ৫০ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ।

ইউনেসকো বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বেসরকারি উদ্যোগ বেড়ে চলেছে, যারা প্রায় ক্ষেত্রেই বেশি খরচে শিক্ষার ব্যবস্থা করছে।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় দেশের অর্ধেক শিশু বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়, যার মধ্যে আছে নিবন্ধিত বেসরকারি স্কুল, প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেন, এনজিও পরিচালিত স্কুল ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় স্কুল।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর অতিরিক্ত চাপ এবং সরকারি বিদ্যালয়ের পাঠদানে অসন্তোষের কারণে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ছে বলে ইউনেসকোর পর্যবেক্ষণ।

প্রাইভেট পড়ানো, ও শিক্ষা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিকাশও এই বেসরকারি শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের শিক্ষার সবচেয়ে বেশি প্রসার হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে, যেখানে বেসরকারি মালিকানায় বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯ হাজার, যেগুলো কিন্ডারগার্টেন হিসেবে পরিচিত এবং মোট বিদ্যালয়ের ২২ শতাংশ।

এছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায়ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শক্ত অবস্থান রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই খাতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩ হাজার থেকে দ্বিগুণ বেড়ে ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। অথচ এই শিক্ষা খাতে সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৯০০টি।

ইউনেসকোর প্রতিবেদন বলছে, সংখ্যায় বাড়লেও বেসরকারি খাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানের দিক থেকে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে।

সরকারি পাঠদান ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড অর্জন করে থাকে। এর তুলনায় বেসরকারি পাঠদানের মধ্যে থাকা শিক্ষার্থীদের মাত্র ৩৬ শতাংশ একই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।

বাংলাদেশে শিক্ষকরাও মূলত বেসরকারি ব্যবস্থাপনাতেই প্রশিক্ষিত বলে এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর ৬০ শতাংশই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪০ শতাংশের বেশি তাদের বিএড ডিগ্রি নিয়েছেন বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে।

শ্রম বাজারে যোগ্যতার চাহিদা বাড়ায় এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা প্রাপ্তির ঘাটতির কারণে বেসরকারি খাতে পাঠদান ও শিক্ষা প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে সিভিল সোসাইটি ইনস্টিটিউশন বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবদানের সুবিধা স্বীকার করা হলেও বলা হয়েছে, এনজিও পরিচালিত এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করতে পারেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোর ফি সরকারি স্কুলের তুলনায় তিন গুণ বেশি, যার কারণে এসব স্কুলের সুফল দরিদ্রতম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না। প্রাইভেট পলিটেকনিকে সন্তানের পড়ার খরচ যোগাতে এক-তৃতীয়াংশ পরিবারকেই ঋণ করতে বাধ্য হতে হয়।

এই পরিস্থিতি বদলাতে সরকারের প্রতি ৫টি সুপারিশ রেখেছে জাতিসংঘ সংস্থাটি।

  • বিনামূল্যে সবার জন্য এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক এবং ১২ বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা। দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশই এই পর্যায়ের বিনামূল্যে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে দরকারি ন্যূনতম তহবিল বরাদ্দের থেকেও অনেক পিছিয়ে। ২০২৫ ও ২০৩০ সালে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এই লক্ষ্য পূরণের পথে অনেকটা যৌক্তিক অবস্থানে রয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।

  • দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের সামর্থ্য বাড়ানো।

  •  à¦¶à¦¿à¦•à§à¦·à¦• প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্পষ্ট ও মান সম্পন্ন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একই ধরনের তদারকি ও সহায়তা প্রক্রিয়া স্থাপন করা। এই উদ্যোগ নেওয়া হলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আগের চেয়ে তুলনামূলক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি যাতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত না করে, কারণ জরিপ পরিচালনার সময় এদেশে বেসরকারি খাতের স্কুল উদ্যোক্তারা অনেক বেশি সরকারি নিয়ম-কানুনের বাধার কথা উল্লেখ করেছেন।

  • শিক্ষা ব্যবস্থাজুড়ে সর্বসাধারণের ভালোর লক্ষ্যে পরিচালিত উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে অবিশ্বাস শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বেসরকারি বিদ্যালয়ের মানসম্পন্ন চর্চাগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ সরকারের।

  • সরকারি শিক্ষা নীতি প্রণয়নে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও একাগ্রতা বজায় রাখা। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজের সব অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

Share if you like