ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন: ডিবি


FE Team | Published: December 14, 2022 20:11:39 | Updated: December 15, 2022 16:31:08


ফারদিন ডেমরা সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন: ডিবি

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করার পর গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে এই তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন।

লাশ উদ্ধারের পর মাস গড়িয়ে গেলেও হত্যামামলার তদন্তে অগ্রগতি না দেখে ফারদিনের পরিবার ও তার সহপাঠিদের অসন্তোষের মধ্যে বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ তাদের তদন্তে পাওয়া তথ্য সাংবাদিকদের জানান। à¦–বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

ফারদিনের লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা তদন্তকারী চিকিৎসক জানালে তার বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা যে হত্যামামলা করেন, তার তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ। পাশাপাশি র‌্যাবও এর ছায়া তদন্ত করছে। দুই সংস্থার ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে বলে সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থীরা অভিযোগও তুলেছিল।

ফারদিনের মৃত্যুর তদন্তে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ পাওয়া গেছে জানিয়ে র‌্যাব বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকার আগে তদন্তে নিজেদের পাওয়া তথ্য তুলে ধরেন ডিবির কর্মকর্তা হারুন।

তিনি বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপাত দৃষ্টিতে আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটি একটি আত্মহত্যা। আমি ডাক্তারের (ময়নাতদন্তকারী) সঙ্গে কথা বলেছি, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেখেছি, সার্বিক দিক দেখে মনে হয়েছে, এটি আত্মহত্যার ঘটনা।”

কী কারণে এই বুয়েটছাত্র আত্মহত্যা করতে পারেন, সে বিষয়ে ফোনে কিছু না জানিয়ে বিস্তারিত শুনতে তার কার্যালয়ে যেতে বলেন।

পরে নিজের কার্যালয়ে হারুন সাংবাদিকদের বলেন, “তার (ফারদিন) স্পেন যাওয়ার কথা ছিল,টাকা ম্যানেজ হয়নি। তার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিল। সবকিছু মিলেই মনে হয়েছে, সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল।”

“সে সাঁতার জানত না, সবকিছু মিলে আমরা মনে করছি এটি আত্মহত্যা,” বলেন তিনি।

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন (২৪) বিতার্কিক ছিলেন। এই বছরই স্পেনের এক অনুষ্ঠানে তার যাওয়ার কথা ছিল। তিনি থাকতেন ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে। তিনি ছিলেন বাবা-মার বড় ছেলে।

গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন।

কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার পর জেনে খোঁজাখুজি করে ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা। তিন দিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়।

ফারদিনের লাশ পাওয়া যায় গোদনাইলে বর্ণালী টেক্সটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানায়।

তবে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। তার মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে৷ মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র৷

এরপর এই বুয়েটছাত্রের মৃত্যু নিয়ে তুমুল আলোচনা র মধ্যে ফারদিনের বাবা রামপুরা থানায় হত্যামামলা করলে তার তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবিকে।

এরপর ফারদিনের বান্ধবী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমাতুল্লাহ বুশরাকে ডিবি গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।

যেদিন ফারদিন নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বুশরার সঙ্গে ছিলেন তিনি। রাতে বুশরাকে রামপুরায় পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে আর পরিচিতজনরা দেখেনি।

মামলার তদন্তে নেমে ডিবি ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে ওই সময়ের পর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের উল্টো দিকে কেরানীগঞ্জে, সদরঘাটে, গুলিস্তানে এবং সর্বশেষ যাত্রাবাড়ীতে তার অবস্থান শনাক্ত করে।

গত ১৭ নভেম্বর ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেছিলেন, একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে ফারদিনকে রাত ২টায় যাত্রাবাড়ী থেকে রূপগঞ্জের তারাবগামী একটি লেগুনায় উঠতে দেখা গিয়েছিল।

তিনি বুধবার বলেন, “বুশরাকে নামিয়ে দিয়ে রাত ৯টার পরে কেরানীগঞ্জের একটি ব্রিজের কাছে গিয়েছিল, এরপর সেখান থেকে জনসন রোডে যায় এরপর গুলিস্তান হয়ে যাত্রাবাড়ীতে যায়। রাত ২টা ৭ মিনিটে লেগুনাতে উঠে। পরে ২টা ৩৪ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজে যায়।

“যে সমস্ত জায়গায় ঘোরাঘুরি করছে, এগুলো পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি সে একাই ছিল, তার সাথে কেউ ছিল না। এছাড়া সে যার যার সাথে কথা বলেছে, তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি।”

ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুর উপর থেকে ফারদিন সেই রাতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলার পক্ষে প্রমাণ মেলার কথা বলেন ডিবি কর্মকর্তা হারুন।

“২টা ৩৪ এর দিকে আমরা দেখেছি, সেখান থেকে একটা শব্দ পানিতে পড়েছে এবং ওই সময়ই আমরা যে মোবাইল পর্যালোচনা করেছি, তাতে ওই সময়ে তার সেখানেই থাকার কথা।”

ওই রাতে সেই শব্দ কীভাবে শনাক্ত করেছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি ডিবির এই কর্মকর্তা।

“আমরা তার মানসিক অবস্থা, তার বিভিন্ন জায়গায় চলাচল এবং ব্রিজের কাছে গিয়ে আমরা যে সেলটা দেখলাম, সেখানে ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায় সে ছিল সর্বশেষ এবং সেখান থেকে আমরা আবছাভাবে যে পানির মধ্যে একটা শব্দ হয়েছে, সেটা আমরা ব্রিজ থেকেও পেয়েছি। এই সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, এইটা একটা সুইসাইডাল ঘটনা।”

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের বক্তব্যে হত্যার আলামতের কথা বলা হলেও ফারদিনের দেহে তেমন কোনো আঘাত ছিল না বলে জানান ডিবি কর্মকর্তা হারুন।

তিনি বলেন, “তার লাশের সুরতহাল রিপোর্টে আঘাতের কোনো চিহ্ন নাই। যদি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হত, আঘাতের চিহ্ন থাকত। মারপিট করা হলে, তার চিহ্ন থাকত, সেটা আমরা পাইনি।

“দ্বিতীয়ত উনাকে যদি কেউ মৃত্যু সংগঠিত করে থাকে, তাহলে তার মধ্যে কিছু আলামত থাকবে। সে আলামতটা কীসের, কাপড়ে শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকবে। ভিক্টিমের শার্ট, বোতাম যেগুলো আছে সবই একই রকম ছিল।”

ডিবির বক্তব্য অনুযায়ী, ফারদিন সুলতানা কামাল সেতু থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করার পর তার লাশ ভেসে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জে।

ফারদিন সেই রাতে লেগুনা থেকে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারে নেমে চনপাড়া বস্তিতে গিয়েছিলেন এবং সেখানে মাদক কারবারিরা তাকে খুন করেছিল বলে র‌্যাবের সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছিল।

তবে হারুন আগের মতো বুধবারও বলেন, ফারদিন চনপাড়ায় যাননি এবং মাদকের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়নি।

“চনপাড়ায় কোনো অবস্থাতেই যায়নি,” বলেন তিনি।

ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর র‌্যাবের এক অভিযান ঘিরে আলোচনায় আসে শীতলক্ষ্যা নদীর ডেমরা পাড়ের বসতি রূপগঞ্জের চনপাড়া।

গত ১১ নভেম্বর চনপাড়ায় র‌্যাবের কথিত এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন চনপাড়ার মাদক কারবারের হোতা হিসেবে চিহ্নিত শাহীন মিয়া ওরফে সিটি শাহীন।

এই খুনের সঙ্গে ফারদিন খুনের কোনো যোগসূত্র না থাকার কথা র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হলেও এই বাহিনীর নানা সূত্র উদ্ধৃত করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবরে আসে, ৪ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টা ৩৫ মিনিটে ফারদিনের অবস্থান ছিল চনপাড়া বস্তি এলাকায়।

মাদকের আখড়ায় ফারদিনের যাওয়ার সে কথায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান তার বাবা ও বুয়েটে তার সহপাঠিরা।

ফারদিনের মধ্যে কখনও কোনো বিষয়ে হতাশা না দেখার কথাও বলেছিলেন তার বাবা নূরউদ্দিন রানা।

ফারদিনের মধ্যে সেদিন কোনো অস্বাভাবিকতা না দেখার কথা বুশরাও বলেন পুলিশকে।

তাকে উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তা হারুন এর আগে বলেছিলেন, “বুশরার বক্তব্য হচ্ছে, তারা যতক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন, ততক্ষণ ফারদিন স্বাভাবিকই ছিলেন। তারা রেস্তোঁরায় খেয়ে নিজ নিজ বিল দিয়েছেন। তাকে রামপুরা নামিয়ে দিয়ে ফারদিন চলে যায়।”

Share if you like