সদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত তার ব্যাপ্তি। মানবতার সেবার জন্য পেয়েছেন তিনি র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার। বিশ্বের তিনটি রাষ্ট্রের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি। একটি কলেজসহ একাধিক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় তার হাত ধরে। বলছি প্রানী বিজ্ঞানী, গবেষক ও ক্যাথলিক পুরোহিত ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিমের কথা যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
কে এই ফাদার টিম?
ফাদার রিচার্ড উইলিয়াম টিম একজন ক্যাথলিক পুরোহিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। পুরান ঢাকার লক্ষীবাজারের সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ঐতিহ্যবাহী নটরডেম কলেজের প্রতিষ্ঠা করার কৃতিত্বও তার।
প্রশ্ন হল সদূর আমেরিকান এক পুরোহিতের সঙ্গে কী করে বাংলাদেশের সম্পর্ক তৈরি হলো।
বাংলাদেশের সাথে ফাদার টিমের সংযোগ
ফাদার টাইমের জন্ম এবং পড়াশোনা শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেইন্ট মেরি স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের পড়া শেষ করে তিনি হলি ক্রস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে জীববিজ্ঞানের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি দর্শনে বিএ পাশ করেন।
ওয়াশিংটনে থেকে তিনি চার বছর ধর্মতত্ত্বের উপর পড়াশোনা করেন। ক্যালেন্ডারে তখন সন ১৯৪৯। দুই বছর হলো ভারত বর্ষ ব্রিটিশ শাসক থেকে মুক্ত। ধর্মতত্ত্বের পড়া শেষে আমেরিকার হলি ক্রস কর্তৃপক্ষ ফাদার টিমকে ঢাকার একটি মিশনারি স্কুল যা সদ্যই একটি কলেজ খুলেছে সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার কথা বলেন। কলেজের নাম সেইন্ট গ্রেগরি। নন্দলাল দত্ত লেন হয়ে লক্ষীবাজারের রাস্তায় উঠলেই দেখা মিলবে ধব-ধবে সাদা দেয়াল আর আর্মেনীয় ধারার জানালা সমৃদ্ধ একটি স্কুল।" এই স্কুলে পড়েছেন নোবেলজয়ী অমর্ত্যসেনও।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ফাদার টিমের অবদান
কেবল সেন্ট গ্রেগরি স্কুলই নয়, ফাদার টিমের সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের আরেকটি বিদ্যাপীঠ যার নাম নটরডেম কলেজ। তার হাতেই ঢাকার নটরডেম কলেজের পথচলা শুরু।
সেইন্ট গ্রেগরি কলেজে যে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করার দায়িত্ব নিয়ে তিনি এদেশে এসেছিলেন তা বর্তমানে নটরডেম কলেজ নামে পরিচিত। কলেজটির পূর্ব নাম সেইন্ট গ্রেগরি কলেজ যা লক্ষী বাজারে অবস্থিত ছিল। ১৯৫২ সালে এটি মতিঝিলের আরামবাগে স্থানান্তরিত হয়।
পঞ্চাশের দশকের শুরুতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে জড়িয়ে পড়েন ফাদার টিম। ৭০-৭১ সালে তিনি নটরডেম কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ডিবেটিং ক্লাবের মতো কলেজটির বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন ফাদার টিম। পরজীববিদ্যায় গবেষণা থাকায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্যারাসিটলজিতে প্রভাষকের ভূমিকা পালন করেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসিটলজি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক্সটার্নাল পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফাদার টিম।
এক সময় ফাদার টিমের রচিত জীববিজ্ঞান বই কলেজের পাঠ্যবই হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। পাকিস্তান আমলে খাদ্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ধান ও পাটের পরজীবীর উপর গবেষণা করেছেন।
বাংলাদেশে তার কাজ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ফাদার টিম খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একাত্তরের সময় বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিক বাঙ্গালীদের ওপর পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার বিষয়ে জানতো না। ফাদার টিম তখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্ব জনমত গঠনে অগ্রনী ভূমিকা রাখে।
ফাদার টিমের চিঠি
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের তিনি পত্র লিখে হিন্দুদের প্রতি হওয়া পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য মূলক আচরণের কথা জানান। এরকইম ২১ জুন ১৯৭১ সালে সেনেটর ফুলব্রাটকে একটি পত্রে তিনি লিখেন,
"হিন্দুদের ত্রান ও পুনর্বাসন থেকে বঞ্চিত করা পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত। তারা হিন্দুদের পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে মেনেই নেয়নি। "
"৫০ রুপি বোনাস, দিনে ৩ রুপি ও ত্রানের খাবারের বিনিময়ে পাক বাহিনী রাজাকারদের কিনে নেয়। এই রাজাকাররাই এখন নিজেদের কাছে আত্মঘাতী দলে পরিণত হয়েছে। "
সেপ্টেম্বর মাসে লেখা আরেকটি পত্রে তিনি গণহত্যার কথা লিখেন।
"তারা (পাকিস্তানী আর্মি) তার (কৃষকের) ছেলে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। চট্টগ্রামের জসিম এবং ফাদার মিশনে ছিলেন। রোগীদের চিকিৎসা করায় পাকিস্তান আর্মি তাদের দোষারোপ করেন। আমি তখন বিশপ জসিমকে বলেছিলাম তোমার আর্মিদের বলা উচিত ছিল যে হিটলারও আহত নারী ও শিশুদের দেখাশোনা করেছে। "
বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে তার অবদান:
বাংলাদেশে মিশনারি প্রতিষ্ঠান তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন ফাদার টিম। বন্যা ও সাইক্লোন কেন্দ্রে ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি সেসব স্থানে মিশন ও ক্লিনিক নির্মাণে অবদান রাখেন তিনি।
প্রাণিবিদ্যায় অবদান
ফাদার টিম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন জীববিজ্ঞানের গবেষক ছিলেন। তিনি পরজীবের ওপর গবেষণা করেন এবং নেমাটডা পর্বের ২৫০টি প্রানীর নামকরণ করেন। এর মধ্যে "Timmia parva" তার নামের ওপর ভিত্তি করেই রাখা।
পুরস্কার
শিক্ষা, চিকিৎসা ও মানবিক কাজের জন্যে ফাদার টিম সারা বিশ্বে সমাদৃত। একটি দেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে তিনি বছরের পর বছর কাজ করেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কার লাভ করেছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ র্যায়মন ম্যাগসেসে এওয়ার্ড।
১৯৮৭ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য এই পুরস্কার লাভ করে। একই বছর সামাজিক উন্নয়নের জন্য আবু সাইদ চৌধুরী পুরস্কার পান এই ফাদার টিম।
মো ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত।