"যাবে না যাবে না করে একদিন আসলেই দেখি ও হেঁটে চলে গেল। আশ্চর্য! আমি একদিকে ঘাড় কাত করে দেখলাম আস্তে আস্তে কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে একটা মানুষ। তখনও বুঝতে বাকি যে ওটাই ইতি, এরপর আর কেউ ফিরে আসছে না। ঘুরেফিরে এখনো ডিসেম্বরের কুয়াশা কিছুটা ভয়ই লাগে। মনে হয় আবার হয়ত মনের কিছুটা খালি করে দিয়ে কেউ একটা, কিছু একটা হেঁটে চলে যাবে, আর ফিরবে না"
একজনের ডায়েরীর পাতায় টুকে রাখা কয়েকটা লাইন পড়া হলো এতক্ষণ। তবে হয়তো অনেকেরই মনে হতে পারে এটা তাদেরই জীবনের কোনো এক ক্লান্ত ডিসেম্বর সন্ধ্যার গল্প। কোনো এক টুকরো মূহুর্তের সাথে হারিয়ে গেছে কোনো এক কুয়াশার চাদরের আড়ালে, অনেকের হয়ত বেশ পুরোনো কিছু স্মৃতি খেলে উঠতে পারে মাথায়।
ডিসেম্বর মাসের সাথে চলে যাওয়া ব্যপারটার সুর খুঁজে পান অনেকেই, সাধারণীকরণের সমীকরণে না ফেললেও মেলানকোলিয়ার এই মিলটা সহজেই এক করে ফেলে অনেককে৷ তবে সবার গল্পই আলাদা, অনন্য, বিচিত্র, কিছুটা বিস্বাদের, কিছুটা সাহসের, কিছুটা আশার৷ তবে সিংহভাগই যেন বিচ্ছেদের, প্রস্থানের, ত্যাগের, হারিয়ে যাওয়া কিছুর।
ডিসেম্বর প্রসঙ্গে সবার আগেই মাথায় এক চেনা গানপোকার ভর যেন খুবই স্বাভাবিক। ওপার বাংলার গীতিকার ও সংগীতশিল্পী সৌরভ সাহার বিষন্ন সুন্দর গান 'ডিসেম্বরের শহরে'। এই গানটি লিখেছেন অরিত্র সেনগুপ্ত। এই গানের প্রতিটা লাইন কবিতার পঙক্তিই যেন, আঙুলের ডগায় ছুঁয়ে দেখা, চোখের সামনে দৃশ্যপট আঁকা।
গানটা আসলে লেখা হয়েছিল অরিত্র সেনগুপ্ত ও অয়ন্তী ঘোষের নাটক 'উইথ লাভ, ক্যালকাটা'র জন্য। কলকাতার এম.এ. ডি. (ম্যাড এবাউট ড্রামা) প্রতিষ্ঠানের অরিজিনাল এই নাটকটি ২০১৭ সালের ২৮-২৯ ডিসেম্বর প্রথম মঞ্চস্থ হয়। সেখানেই এই গানটির শুরু।
দুইদেশের মাঝে না হয় কাঁটাতারের বেড়ার সীমানা আছে কঠোর কড়াকড়ির। কিন্তু সুরের কাছে তো আর এসব বাঁধার কোনো মানে নেই। ওপার বাংলার এই গানটি জমাট বেঁধে যায় এপারের শ্রোতাদের মনে। ডিসেম্বরের শহর কলকাতার হারিয়ে যাওয়াদের ব্যাকুলতায় এখানেও জাগে উদ্বিগ্নতা।
গানটির কথায় কি এমন আছে যে একটা গান দিয়েই জানান দেওয়া যায় বিদায় কেন অনিবার্য? শেষ হয়েও না শেষ হওয়া কোনো গল্পের মতো কাউকে হয়তো গিটারের টুংটাংয়ে স্মৃতিচারণের মতো মনে করছে একজন৷ জানিয়ে দিচ্ছে, তার জীবনের কোনো এক এমন অংশে গায়কের জীবন জড়ানো, যেখানে প্রিয়তমায় সত্যটা শুধু তারই জানা।
আজকের সেই একই প্রিয়তমা হয়তো আর কাছে নেই, কোনোদিন আসবেও না, তাও তার সেই সত্যটাই মায়াবী গায়কের কাছে। আর কারো তাকে জানা নেই, চেনা নেই। দিনশেষে কার জন্য বেদনায় ম্রিয়মাণ মুখ লুকিয়ে প্রিয় কলকাতা শহর ছেড়ে অন্য কোথাও সে চলে যেতে চায়, তাও কারো কোনোদিন জানা হবে না।
যার জানা আছে, তার আর পিছুডাক দেওয়াও হবে না, না আছে প্রিয়তমার ঘরে ফেরার অভ্যেস।
তাই চেনা কলকাতায় এই পরিবর্তনকেই মেনে নিয়ে এখন শুধু ক্লান্ত স্মৃতিচারণ করছেন গায়ক। হারিয়ে যাওয়া, না পাওয়া, এগিয়ে যাওয়া মানেই ভালোবাসার ইতি না, নতুন এক অধ্যায়ও হতে পারে৷ যেখানে ভালোবাসা শীতের সন্ধ্যার মেলানকোলিয়া হয়ে আলোয় ভেজা পার্কস্ট্রিটে দেখা দেয় একদিন, কিন্তু পিছু ডাকে না।
অতীত ফেলে সামনে এগনো মানেই তা ছুড়ে ফেলে দেওয়া কি? অতীত হতে পারে ভবিষ্যতের রসদ। পুরনো ব্যথা, জরা, ক্লান্তি, বেদনা, ব্যর্থতাকে পুরনো বছরে রেখে নতুন দিনের দিকে তাকানোর রসদ আসে সেই অতীত থেকে শেখা জীবনপাঠেই।
তাই বছরের শেষ এই মাসটির সাথে যেন পুরনো কিছুর হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা প্রবল।
বছরের শেষ মাসটা যেন এভাবেই হয়ে যায় বিদায়ের মাস। কুয়াশার চাদরের আড়ালে হারিয়ে যায় প্রিয়জন, কখনোবা নিয়ন আলোয় পকেটে হাত রেখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার আড়ম্বরতার সাথে, চুপচাপ হয়ে - কুয়াশার চাদরে দুয়েকটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিশে। অথবা কোনো ক্ষুদেবার্তার নিষ্ক্রিয়, নিষ্ঠুরতায়।
এই শেষ মাসের বিদায়ও যেন কানে বাজা ডিসেম্বরের শহরের গানপোকার মতো, বিদায়কে উপলব্ধি করে সামনে এগোনোর মতো।
'ঘরে ফেরা তোমার অভ্যাসে নেই
আর পিছু ডাকা আমার সিলেবাসে নেই
ফিরে পাওয়া এই শহরের ইতিহাসে নেই
বিষাদ চিহ্ন সানগ্লাসে নেই।
ডিসেম্বরের শহর থেকে যায় অপেক্ষায়,
প্রাক্তন ভালোবাসা নিয়ে প্রাক্তন কলকাতায়।
সব শীতের শেষে হয়তো বসন্ত আসে না
সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপ; তোমার-আমার
কলকাতায়...'
-ডিসেম্বরের শহরে