প্রশান্ত মহাসগর যে গতিতে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তাতে আগামী ২০ থেকে ৩০ কোটি বছরের মধ্যে পৃথিবী আবার ‘সুপারকন্টিনেন্ট’ বা অতি মহাদেশ পেতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটি এবং চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সুপারকম্পিউটারের মাধ্যমে পৃথিবীর টেকটোনিক প্লেটের বিবর্তন বিশ্লেষণ করে একটি মডেল তৈরি করেছেন, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের পৃথবীর সম্ভাব্য ভূগঠনের একটি চিত্র তারা তুলে ধরেছেন।
তাদের ওই গবেষণার ফলাফল গত ২৮ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল সায়েন্স রিভিউ জার্নালে প্রতাশিত হয়েছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সিএনএন।
ভূতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে ভূত্বক প্রধানত সাতটি বড় ও কয়েকটি ক্ষুদ্র গতিশীল কঠিন প্লেট দিয়ে গঠিত, যেগুলো গুরুমণ্ডলের আংশিক তরল ও উষ্ণ ম্যাগমার ওপর ভাসছে। সবসময় অবস্থান পরিবর্তনের মধ্যে থাকা এসব প্লেট একটির সঙ্গে আরেকটি ধাক্কা খেলে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির উদগীরণের মত ঘটনা ঘটে।
‘কন্টিনেন্টাল ড্রিফট’ নামের এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বহুকাল আগে সবগুলো মহাদেশ পরস্পর যুক্ত ছিল। এদের একসঙ্গে প্যানজিয়া বা সুপারকন্টিনেন্ট বলা হত। কালের আবর্তে টেকটোনিক প্লেটগুলো দূরে সরে গিয়ে আলাদা আলাদা মহাদেশে বিভক্ত হয়।
কার্টিন ইউনিভার্সিটি ও পিকিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের গবেষণা সত্যি হলে ২০ থেকে ৩০ কোটি বছরের মধ্যে আবারও পৃথিবীর সব ভূভাগ পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে ‘সুপারকন্টিনেন্ট’ গড়তে পারে। তখন আমেরিকা এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে বলে এর নাম দেওয়া হচ্ছে অ্যামেশিয়া।
কার্টিন ইউনিভার্সিটির আর্থ ডায়নমিকস রিসার্চ গ্রুপের ফেলো এবং প্রধান গবেষক চুয়ান হুয়াং বলেন, “গত দুইশ কোটি বছর ধরে পৃথিবীর মহাদেশীয় প্লেটগুলো ৬০ কোটি বছর অন্তর অন্তর একটি সুপারকন্টিনেন্ট গঠন করে আসছে, যাকে ‘সুপারকন্টিনেন্ট’ সাইকেল বলা হয়। এর মানে হল, পৃথিবীর বর্তমান মহাদেশগুলো কয়েক কোটি বছরের মধ্যে আবার একত্রিত হতে চলেছে।”
গবেষক দলটির কম্পিউটার মডেল বলছে, পৃথিবীর গঠনের সময় থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর শীতল বা ঠাণ্ডা হওয়ার প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের তলদেশের টেকটোনিক প্লেটের পুরুত্ব ও শক্তি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে।
আটলান্টিক কিংবা ভারত মহাসাগর সঙ্কুচিত হলে সুপারকন্টিনেন্ট গঠনের প্রাকৃতিক এই প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। বিজ্ঞানীতের ধারণ, সর্বশেষ সুপারকন্টিনেন্ট ভেঙে যখন মহাদেশগুলো আলাদ হয়ে গেল, তখনই এ মহাসাগর দুটি তৈরি হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, সর্বশেষ প্যানজিয়াটি গঠিত হয়েছিল ৩২ কোটি বছর আগে। ১৭ থেকে ১৮ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে যখন ডাইনোসরের ঘুরে বেড়াত, সেসময় সেই প্যানজিয়া ভেঙে যায়।
অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো মহাসাগর প্রশান্তের বিশাল জলরাশি প্রকৃতপক্ষে পানথালাসা সুপার ওশানের অবিশিষ্টাংশ; ৭০ কোটি বছর আগে পুরনো একটি সুপারকন্টিনেটে ভাঙন শুরু হলে এই পানথালাসা তৈরি হয়েছিল।
গবেষকরা বলছেন, যখন টেকটোনিক প্লেটগুলো পাতলা হচ্ছে এবং শক্তি হারাচ্ছে, তখন অতীতের বিশাল ভূমি পিণ্ড ঘেরা একটি অতি মহাসাগরের প্লেটগুলো কাছাকাছি চলে আসায় নতুন সুপারকন্টিনেন্ট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
প্রতি বছর কয়েক সেন্টিমিটার করে কমছে প্রশান্ত মহাসাগর; ডাইনোসর যুগে এই সংকোচন শুরু হয়। নতুন গবেষণা মডেল বলছে, এখন প্রশান্ত মহাসাগরের যে বিস্তার, আগামী ৩০ কোটি বছরের কম সময়ে তা উধাও হয়ে যাবে।
গবেষণা দলের প্রধান চুয়ান হুয়াং বলেন, “নতুন সুপারকন্টিনেন্টের নাম অ্যামেশিয়া; কারণ কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, প্রশান্ত মহাসাগর হারিয়ে যাবে এবং আমেরিকা এশিয়ার সঙ্গে ধাক্কা খাবে। পৃথিবীর এই গঠনে অস্ট্রেলিয়া ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমত অস্ট্রেলিয়া এশিয়ার সঙ্গে ধাক্কা খাবে, এরপর আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে সংযোগ তৈরি করবে।”
গবেষণার সহ-লেখক কার্টিন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের অধ্যাপক ঝেং জিয়াং লি বলেন, অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে প্রতি বছর ৭ সেন্টিমিটার করে এশিয়ার দিকে এগোচ্ছে। ইউরেশিয়া এবং আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ধীরগতিতে এগোচ্ছে।
কেমন হবে পৃথিবী?
গবেষক লি বলেন, মহাদেশ ও মহাসাগরগুলোর এই পরিবর্তন জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ ঘটাবে। বিশেষ করে মহাদেশগুলোর টেকটোনিক প্লেটেগুলোর মধ্যে ধাক্কার কারণে যখন সমুদ্রের জলধারা থমকে যায় কিংবা প্লেট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে নতুন জলপ্রবাহ সৃষ্টি হয়।
সাড়ে ৪ কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা থেকে যখন অস্ট্রেলিয়া বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, সেসময় অ্যান্টার্কটিকের বরফ স্তূপ গঠিত হয়েছিল। গবেষকরা বলছেন, মহাদেশীয় প্লেটগুলোর মধ্যে ধাক্কার ফলে আরও বেশি বেশি ভূমিকম্প ঘটবে।
লি বলেন, ভারত ও ইউরেশিয়ার প্লেটগুলো সাড়ে ৫ কোটি বছর ধরে ধাক্কা খাওয়ার ফলে মাঝেমধ্যে ভূ-কম্পন ঘটেছে। এই প্লেটগুলোর প্রাথমিক প্রভাব তিব্বত মালভূমি এবং হিমালয় গঠন করেছিল।
নতুন একটি সুপারকন্টিনেন্ট গঠিত হলে জীববৈচিত্র্যও হ্রাস পাবে। গবেষক লি বলেন, “আমরা যতদূর জানি, অ্যামেশিয়া গঠন হলে পৃথিবীর নাটকীয় পরিবর্তন ঘটবে। সমুদ্র স্তর হয়ত নিচে নেমে যাবে। অতিকায় মহাদেশের অভ্যন্তরের বিশাল এলাকা প্রচণ্ড শুষ্ক হয়ে যাবে এবং প্রতিদিন তাপমাত্রা থাকবে প্রচণ্ড।
“বর্তমানে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশ, এগুলোর প্রত্যেকটির জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে আলাদা। তাই ২০ বা ৩০ কোটি বছর পরে পৃথিবী দেখতে কেমন হবে কেবল কল্পনা করাই সম্ভব।”
বিজ্ঞানীরা এখনও পৃথিবীর মহাদেশগুলোর চক্র বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাপ ও মধ্যাকর্ষণ বলের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্লেট টেকটোনিক কীভাবে শুরু হয়েছিল, প্রথম মহাদেশ কবে গঠন হয় এবং সেই সঙ্গে সুপারকন্টিনেন্ট চক্র কীভাবে চলে, এই গবেষণায় সেটাই উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা।