Loading...
The Financial Express

পেলে: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

| Updated: January 01, 2023 11:02:36


পেলে: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই

‘লাভ, লাভ, লাভ ফরেভার’- পেলের অফিশিয়াল সোশ্যাল মিডিয়াতে মৃত্যু সংবাদের পোস্টের শেষ লাইন। ফুটবলের রাজা পেলের জীবনের উদ্দেশ্য এই এক লাইনেই যেন প্রকাশ পায়। দুই পা এর জাদুতে গোটা বিশ্বকে মাতিয়ে রেখে সবার মাঝে চিরকাল ভালোবাসা বিলিয়ে চলে গেলেন কিংবদন্তী। কয়েক প্রজন্মকে ফুটবলের ভালোবাসায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ পেলে। জাতিগত বিদ্বেষে নিমজ্জিত ব্রাজিলের সব মানুষকে তিনি এক কাতারে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, শুধু ফুটবলের প্রতি ভালোবাসার বিনিময়ে। জাতি, বর্ণ, ধর্ম- সব পেরিয়ে সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘ও রেই’ বা রাজা। 

গত বৃহস্পতিবার সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পেলে। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। পেলের মৃত্যুতে পুরো ফুটবল বিশ্বে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। ব্রাজিলেও ঘোষণা করা হয়েছে তিন দিনের জন্য রাষ্ট্রীয় শোক। ফুটবলকে নান্দনিক খেলায় রূপান্তরিত করেছে ব্রাজিল। আর এর প্রবর্তক ছিলেন পেলে।

১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ছোট শহর ত্রেস কোরাকসে জন্ম হয় পেলের। বিদ্যুতের আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের নামে তার নাম রাখা হয় এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো। বলা বাহুল্য, পরবর্তীতে নামের সম্মান রেখেছেন তিনি। বিদ্যুতের ক্ষীপ্রতায় মাঠ দাপিয়ে প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে গোল করেছেন শত শত। ফুটবলের অন্যতম সেরা ড্রিবলার বলা হয় পেলেকে। তখনকার সেরা ডিফেন্ডারদেরকে বোকা বানিয়ে বল কাটিয়ে করেছেন বহু গোল। এছাড়াও তিনি দুর্দান্ত ফ্রি-কিক নিতেন।

ফিফার মতে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ পেলের শৈশব ছিল দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। এক সময়ে তিনি দোকানের চাকর, মুচি ও বাদাম বিক্রেতার কাজও করেছিলেন। মোজার ভেতরে শুকনো আবর্জনা ঢুকিয়ে এটিকে বল বানিয়ে ত্রেস কোরাকসের অলি-গলিতে ফুটবল খেলতেন তিনি।

ব্রাজিলের হয়ে খেলা শুরু করার পর। ছবি: উইকিডাটা

১৯৫০ বিশ্বকাপে ব্রাজিল যখন ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে যায়, তখন পেলে তার বাবাকে কাঁদতে দেখে। ১০ বছর বয়সে বাবার কাছে পেলে ওয়াদা করেছিল যে একদিন সে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাবে। এর মাত্র আট বছরের মাথায় ১৯৫৮ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে। ফাইনালে দুই গোল করেছিলেন পেলে।

পেলে একমাত্র খেলোয়ার হিসেবে তিনটি বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলের জন্য। ১৯৫৮, ১৯৬২ আর ১৯৭০ সালে। তিনটিতেই পেলের অবদান ছিল। তিন বিশ্বকাপে তিনি করেন মোট ১২ গোল। এই অবিস্মরণীয় সাফল্যের জন্য বিশ্বকাপের জুলে রিমে ট্রফিটি ব্রাজিলকে পাকাপাকিভাবে দিয়ে দেয়া হয়।

১৯৭০ বিশ্বকাপ জয়ের পর পেলের উদযাপন। ছবি: বিবিসি

১৫ বছর বয়স থেকে ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোসের জন্য খেলা শুরু করেন পেলে। এরপর প্রায় ২১ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি করেন ৭৩২ গোল। যার মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে করেন ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোল। অফিশিয়াল গোল ছাড়াও, ফ্রেন্ডলি ম্যাচ সহ হিসাব করলে পেলের গোল সংখ্যা একটি বিশ্বরেকর্ড। ১৩৬৩ ম্যাচ খেলে পেলে করেছেন ১২৭৯ গোল।

ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময়ই তিনি খেলেছেন সান্তোসের হয়ে। বিশ্বকাপ জেতার পর ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাব কাড়ি কাড়ি টাকার বিনিময়ে পেলেকে নিজেদের দলে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পেলে নিজ দেশ ব্রাজিল ছেড়ে যাননি। ১৯৬১ সালে পেলেকে ব্রাজিলের জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এমন নজির ফুটবল বিশ্বে আর কখনো দেখা যায়নি।

পেলের ছিল ভুবন ভোলানো কারিশমা। ১৯৬৭ সালে তিনি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ নাইজেরিয়াতে খেলতে যান একটি ম্যাচের জন্য। পেলের খেলা দেখা জন্য দেশে রীতিমত ৪৮ ঘন্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছিল। সরকারী বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা একই গ্যালারিতে বসে উপভোগ করেছিল পেলের খেলা।

পেলের বিখ্যাত এক গোলের ছবি। ছবি সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ

১৯৬৯ সালের ১৯ নভেম্বর ক্যারিয়ারের ১০০০তম গোল করেছিলেন পেলে। হাজার গোলের বিজয়োল্লাস উদযাপনে গ্যালারির শত শত দর্শক মাঠে ঢুকে পড়েছিল। মাঠ খালি করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লেগেছিল পুলিশের। এরপর থেকে সান্তোসে ১৯ নভেম্বরকে পেলে দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৯ সালে অলিম্পিক পেলেকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদের তকমা দেয়। তিনি তার ক্যারিয়ারে তিনটি বিশ্বকাপ, দুইটি ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ ও নয়বার সাও পাওলো স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এছাড়াও ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে তিনি খেলেন আমেরিকার ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসে। সেখানেও জিতেন সকার বল চ্যাম্পিয়নশিপ।

পেলের শেষ ম্যাচের দিন। ছবি: পোগ গোল

১৯৭৭ এর ১ অক্টোবর পেলে তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন নিউ ইয়র্ক কসমস আর তার ভালোবাসার ক্লাব সান্তোস- দুই দলের হয়েই। এটি সম্ভব হয়েছিল এক অনন্য উপায়ে। সেদিন নিউ ইউর্ক কসমস ও সান্তোসের ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। ম্যাচের প্রথম হাফ তিনি খেলেন কসমসের হয়ে, আর দ্বিতীয় হাফ সান্তোসের জার্সিতে। সেই ম্যাচে কসমস ২-১ গোলে জিতেছিল। পেলের ক্যারিয়ারের শেষ গোল ছিল কসমসের জার্সিতে। ৩০ মিটার দূর থেকে দূর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে গোল করেন তিনি। ম্যাচের দ্বিতীয় হাফে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। সবাই তখন বলেছিল রাজার বিদায়ে যেন আকাশও কাঁদছে অঝোরে।

পেলে একবার বলেছিলেন, “আমার জন্ম হয়েছে ফুটবল খেলার জন্য, ঠিক যেভাবে বিথোভেনের জন্ম সংগীতের জন্য আর মাইকেলে এঞ্জেলোর জন্ম ছবি আঁকার জন্য।” সেই শৈল্পিক ফুটবলের জনক, ব্রাজিলিয়ান সাম্বার পথিকৃৎ পেলে চলে গেলেন চিরতরে। কিন্তু পৃথিবীর বুকে ফুটবল যতিদন বেঁচে থাকবে, ততদিন অমর হয়ে থাকবেন পেলে। কারণ, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।

ফাইয়াজ আহনাফ সামিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic