বৈদেশিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় জানিয়ে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত সংস্থা বিএফআইইউ এর প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেছেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সহজ নয়। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
সোমবার ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
গত অর্থবছরে টাকার অঙ্কে মোট ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্যও বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
আর্থিক খাতে গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৮ হাজার ৫৭১টি সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) করার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় তা ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। ওই অর্থবছরে এমন লেনদেনের তথ্য ছিল ৫ হাজার ২৮০টি।
২০২১-২২ অর্থবছরে সন্দেহজনক এসব রিপোর্টে ৯ হাজার ৫৫৯টি লেনদেনের তথ্য তুলে ধরা হয়; যেগুলোর মাধ্যমে ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার হাতবদল হয়, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৮৩ কোটি টাকা বা ২৯ শতাংশ বেশি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিএফআইইউ প্রধান বলেন, “দেশ থেকে অর্থপাচারের কোনো তথ্য নেই। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা দূরহ।”
আরেক এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “মানি লন্ডারিংয়ে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলায় বেশ কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
কোন মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “বৈদেশিক বাণিজ্যে সবচেয়ে পাচার হয় বেশি।”
‘আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের’ মাধ্যমে এভাবে অর্থপাচার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তদন্তে জানা গেছে, কোনো কোনো পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ ওভার ইনভিয়েসিং হয়েছে। এরপর চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে বড় বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। এখন আর ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে না। একইভাবে আন্ডার ইনভয়েসিং কমাতেও কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।”
ডিজিটাল হুন্ডিতে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় কয়েকটি মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ ও এজেন্টশিপ বন্ধ করে দেওয়ার তথ্যও তুলে ধরেন তিনি।
অর্থপাচারে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেওয়ায় সেখানেও নজরদারি বাড়িয়েছে বিএফআইইউ।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৫ বছরে অবৈধভাবে ভার্চুয়াল মুদ্রা ও অনলাইন ফরেক্স ট্রেডিং সংক্রান্ত ১৭টি ঘটনা শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় ৫৩ জন আটক হয়েছেন।
আর্থিক খাতের এ গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধান বলছে, ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে কৃষক, গৃহিণী, শিক্ষার্থী, ফ্রিল্যান্সার, আইটি ব্যবসার মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রার অবৈধ ব্যবসা চলছে। তারা দেখেছে, এসব ব্যবসায় লেনদেন হওয়া অর্থের ৭৪ শতাংশ হয়েছে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে।
বার্ষিক প্রতিবেদনে ব্যাংকের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে হওয়া লেনদেনে নিবিড় তদারকি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই কমার্স প্রতিষ্ঠানের সন্দেহজনক লেনদেনও বেড়েছে। ৫২টি ই কমার্স প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করে ৩৩টির সারাংশ আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে নগদ অর্থ লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, ১০ লাখ টাকা বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা বা উত্তোলন করলে তা ক্যাশ ট্রানজেকশন রিপোর্ট বা সিটিআর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হয়।
গত অর্থবছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৯০ হাজারটি লেনদেনের মাধ্যমে নগদ টাকার উত্তোলন ও জমা হয়েছে।
গত অর্থবছরে ২১ হাজার ১১৩ কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয়েছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৪৬ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪ হাজার ৪৩৮ কোটি নগদ টাকার লেনদেন হয়েছে।
অর্থাৎ ১০ লাখ টাকা ও এর চেয়ে বেশি অঙ্কের নগদ অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ হচ্ছে ২১ হাজার ১১৩ কোটি টাকা।
নগদ অর্থ লেনদেন রেকর্ড বাড়ার বিষয়ে বিএফআইইউ বলছে, কোভিড মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা বাড়াতে নগদ টাকার লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার চাহিদার আলোকে গত অর্থবছরে ৮৪টি প্রতিবেদন সরবরাহ করেছে বিএফআইইউ। আগের অর্থবছরে যা ছিল ৭৩টি। এর মধ্যে জালিয়াতি সম্পর্কিত ৫৬টি, ঘুষ ও দুর্নীতির ৭টি, মুদ্রাপাচার সংক্রান্ত ৯টি এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত একটি লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়।
বিএফআইইউ শতভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে দাবি করে মাসুদ বিশ্বাস বলেন, “বিধি অনুযায়ী অর্থ ও জনবলসহ লজিস্টিক সাপোর্ট দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখানে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে।”
এসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ, বিএফআইইউ পরিচালক রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত পরিচালক কামাল হোসাইন উপস্থিত ছিলেন।