একটা সময় ছিলো যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ভবনের ওখানে কিংবা সামনের চা দোকানে গিটার হাতে নিয়ে টুংটাং করতে দেখা যেত এক ভদ্রলোককে। মাথায় ক্যাপ, পরনে হাতা গুটিয়ে পরা বর্ণিল ফুল শার্ট, আর সাথে গিটারে অনবদ্য সুরের ঝংকার। কখনো কখনো গিটার বাজাতে বাজাতে ঠোঁটের কোণায় ঠাঁই পেতো একটা সিগারেট। কঠিন সব সুর এক লহমায় তুলে আনেন তার গিটারে, আশেপাশের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত শোনে। সেই মানুষদের ভেতর ইব্রাহিম আহমেদ কমলের মত মহারথি যেমন আছেন, তেমনি আছেন সে সময়ের তরুণ কবি-গায়ক মুয়ীয মাহফুজ কিংবা প্রবর রিপন। আর যে মানুষটি বাজিয়ে চলেছেন অবিরাম, তার নাম নিলয় দাস।
প্রখ্যাত নজরুল গবেষক সুধীন দাস ও সঙ্গীতশিল্পী নিলীমা দাসের জ্যেষ্ঠপুত্র নিলয়। জন্মেছিলেন ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
শৈশব থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে হাতেখড়ি। নজরুলসঙ্গীতে বিশেষ দখল রাখতেন। তবে কিশোর বয়সে সমবয়সী নয়ন মুন্সীর (১৯৬১-৮১) গিটার বাদন শুনে তার ভালো লাগা তৈরি হয় গিটারের প্রতি।
সে অর্থে কোন গুরু পাননি। কোরিয়ান এক ভদ্রলোকের কাছে কিছুদিন শেখেন। তারপর নিজে নিজেই। প্রথম দিকে শাস্ত্রীয় বিভিন্ন গানের সুর গিটারে তুলতেন। এরপর পাশ্চাত্য গানগুলো নিয়েও কাজ শুরু করেন।
বাংলাদেশের মানুষ ব্লুজ, জ্যাজ, কান্ট্রি, ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল, নিওক্লাসিকাল সহ বিভিন্ন জঁনরা আলাদাভাবে বুঝতে শিখেছিল তার গান থেকেই।
কত যে খুঁজেছি তোমায়: নিলয়ের প্রথম এলবাম। ছবি: সুরের আকাশ
১৯৮৮ সালে নিলয়ের প্রথম অ্যালবামটি আসে সারগামের ব্যানারে। সেলফ টাইটেলড এই অ্যালবামটিতে কাওসার আহমেদ চৌধুরী, আহমেদ ইউসুফ সাবের ও আসিফ ইকবালের মত গীতিকারদের গান ছিলো। সুর-সঙ্গীত করেছিলেন ফোয়াদ নাসের বাবু।
এই এলবামে কত যে খুঁজেছি তোমায় গানের সুরে ছিলো স্প্যানিশ ছাপ। ইব্রাহিম আহমেদ কমল তখন তার কাছে শিখছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলছেন, "নিলয় দার হাতে রিদম এত ভালো ছিলো যে, স্প্যানিশ ফ্লামেনকোর সুরও অবলীলায় বেজে উঠত। উনি আমাদের যখন লেসন দিতেন, বুঝে উঠতে পারতাম না কীভাবে বাজাবো। কিন্তু তিনি অবলীলায় বাজিয়ে যেতেন।"
নিলয় এই অ্যালবামে বিভিন্ন ধাঁচের গান করেন। আগের বছরের (১৯৮৭) ডিসেম্বরের শেষে চলে গেছেন তার প্রিয় বন্ধু হ্যাপি আখন্দ। হ্যাপির সাথে জ্যাজ বাজাতেন তিনি। হ্যাপির হঠাৎ প্রয়াণ নিলয়কে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে চলছিলো। তাই 'হ্যাপি' গানটিতে তার উদ্দেশ্যে বলছেন- 'গিটার আর পিয়ানোর সুর বেজে ওঠে তোর নিপুণ হাতে/ আবার এলো যে সন্ধ্যা মনে পড়ে যায় মাঝরাতে।" গানটি তিনি নিওক্লাসিকাল ধাঁচে করেন।
এই অ্যালবামে শেষ গানটি ছিলো 'যখনি নিবিড় করে'। এই গানটিতে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটান নিলয়। সঞ্চারী অংশের আগে কিছুটা বেহালার সুরের মত করে তার বাজানো গিটার বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য ছিলো একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
নিলয়ের দ্বিতীয় অ্যালবাম 'বিবাগী রাত' বাজারে আসে ১৯৯২-এ। সঙ্গীতায়োজন করেছিলেন আশিকুজ্জামান টুলু। এই অ্যালবামে মহীনের ঘোড়াগুলির 'হায় ভালোবাসি' গানটি নিলয় জ্যাজধর্মীভাবে গেয়েছিলেন।
জেনোমস ও ট্রিলজি নামে দুটো ব্যান্ড করেছিলেন তিনি। ট্রিলজি ব্যান্ডটি নিয়ে নব্বই দশকে ঢাকার মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। এছাড়া স্টারস-১ অ্যালবামে 'অবহেলা' গানটি করেন।
গিটারই ছিল নিলয়ের ধ্যান-জ্ঞান। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ
'দেখা হবে বন্ধু' অ্যালবামে করেন 'এইটুকু খোলা রেখো পথ'। 'টুগেদার' অ্যালবামে করা 'লাশ কাটা ঘর' গানটি বাংলা হরর গানের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় কাজ। এমন সাইকেডেলিক কাজ খুব একটা হয়নি বাংলায়। 'তুমিহীনা সারাবেলা' (১৯৯৭) অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চুর সুর-সঙ্গীতে 'এ শহর ডুবে যায়' নামে দুর্দান্ত একটি ব্লুজ গান করেন। নিয়াজ আহমেদ অংশুর চমৎকার লিরিকের সাথে বাচ্চু ও নিলয়ের গিটার গানটিকে বাংলা ব্লুজের এক মাইলফলকে পরিণত করেছে।
নিলয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে দক্ষ ছিলেন, তাই গানের ভাব ও রস ভালো ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। দরকার অনুযায়ী পরিমিতভাবে এক্সপ্রেশনের প্রয়োগ করতেন। তিনি গিটার প্রশিক্ষক হিসেবে শিখিয়েছেন ইব্রাহিম আহমেদ কমল, পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার, লিংকন ডি কস্টার মত শিল্পীদের। প্রিয় বন্ধু হ্যাপি আখন্দের নামে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন 'হ্যাপি স্কুল অব মিউজিক।' ন্যূনতম ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যও ছিলো না তার। গিটার শেখাতেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে। কে বেতন দিলো আর কে দিলো না সেসব নিয়ে ভাবতেনও না।
ঢাকার বিভিন্ন হোটেলে সেসময় বিভিন্ন ব্যান্ডের পারফর্ম করা ছিলো নিয়মিত ব্যাপার। নিলয়ের সাহচর্যেই ওয়ারফেজ, রকস্ট্রাটা, ইন ঢাকার মত ব্যান্ডগুলো এরকম অনুষ্ঠানে গান করতে ও বাজাতে শুরু করে।
আজাদ রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির প্রধান গিটার প্রশিক্ষকের পদে নিয়োগ করেছিলেন। নিলয় শুধুমাত্র গিটার ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ করে রাখতেন দর্শকদের। বড়ে গুলাম আলী ও মেহেদি হাসানের ক্লাসিকালের সাথেও গিটার বাজিয়ে প্রভূত প্রশংসা পেয়েছিলেন।
নিলয় দাসের দ্বিতীয় ও শেষ এলবাম বিবাগী রাত। ছবি: সুরের আকাশ
নিলয়কে নিয়ে স্টারস-১ (১৯৯৩) অ্যালবামের রেকর্ড চলাকালীন এক মজার স্মৃতি ফেসবুকে লিখেছেন সুরকার আশিকুজ্জামান টুলু। নিলয় সারা রাত ক্যাসেট শুনতেন। বিশেষত পিঙ্ক ফ্লয়েড। গিটারে তুলতেন সান্টানা, ইগলস, ডায়ার স্ট্রেইটসহ অনেকের সুর। সাধারণত সকালে ঘুমাতে যেতেন, সন্ধ্যায় উঠতেন। একবার এরকম সন্ধ্যায় উঠে টুলুর সাথে এক রেকর্ডে যান নিলয়। সারগামের মালিক বাদল নিজেও ছিলেন টুলুর ভাষায় 'ভ্যাম্পায়ার বাদল'। (নিশাচর)
তারপর সারারাত ধরে রেকর্ড করে রেললাইনের পাশে থাকা শ্রমজীবী মানুষদের সাথে তারা শেষরাতে খেয়েছিলেন। টুলুর লেখা থেকে আরো জানা যায়, ক্যাসেটের ফাইনাল কভারের ছবি তোলার সময় শুটিং ছিলো সকাল আটটায়। সবাই এলেও নিলয় আসেননি, কারণ উনি (টুলুর ভাষ্যমতে) ভূমিকম্প হয়ে গেলেও সকালে উঠতে পারতেন না।
তবে ১৯৯২/৯৩ সালের পর বিভিন্ন মিক্সড অ্যালবামে গান করলেও ট্রিলজি ব্যান্ডকে আর এগিয়ে নেননি তিনি। নিলয়ের নিরীক্ষাপ্রবণ মন মানতে পারেনি ইন্ড্রাস্ট্রির ভেতরের অনেক ব্যাপার। নিলয় এমনিতেই প্রচারবিমুখ ছিলেন, তার সাথে যুক্ত হলো অভিমান। ১৯৯৭ এর পর বেশ কয়েকবছর গান থেকে তিনি পুরোপুরি দূরে। এরপর মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ভবনের ওখানটাতে তাকে দেখা যেত।
সে সময়ের তরুণ কবি ও বর্তমানে সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য প্রবর রিপন যেমন বলছেন, "আমি যখন আইবিএর ছাদে দাদাকে বাজাতে শুনি, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মত নয়। তার মতো একজন গিটারিস্টের বাদন সরাসরি শুনতে পেয়েছি, এটা অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়।" প্রবর তখন ছিলেন মনোসরণি ব্যান্ডের সাথে।
২০১২ সালে নিলয় দাসের স্মরণে অনুষ্ঠিত 'ট্রিবিউট টু নিলয় দাস'। ছবি: ইমতিয়াজ আলম বেগ
মৃত্যুর সময়ও সেই সাধনা ছাড়েননি তিনি। হৃদরোগে আক্রান্ত নিলয় তখন চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন। ডাক্তারকে বলেছিলেন, "আমার বাম হাতে স্যালাইন দেবেন না, তাহলে আর গিটার বাজাতে পারবো না।"
ফিডব্যাক ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট লাবু রহমান ছিলেন তার বন্ধু। লাবু বলেন, "নিলয় খুব ভালো বন্ধু ছিল। বাংলাদেশে মেটাল ব্যান্ড তৈরির নেপথ্য কারিগরও সে। দুঃখের বিষয় খুব কম লোক তার সম্পর্কে জানে।"
নিলয়কে বাংলাদেশের একমাত্র 'ট্রু নিওক্লাসিকাল গিটারিস্ট' বলেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। ২০১২ সালে নিলয় দাসের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, "আজ আর কেউ বাংলাদেশে ওর মত করে গিটার বাজাতে পারে না। হি ওয়াজ দি ওয়ান এন্ড অনলি নিওক্লাসিকাল গিটারিস্ট অব দিস কান্ট্রি। আমরা ওকে হারিয়ে ফেলেছি, অনেক অভিমান নিয়ে ও চলে গেছে।"
মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।