দৈনিক নগদ জমার হার (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমার (এসএলআর) হার সংরক্ষণে ঘাটতিতে পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকা ধার নেয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ; যেজন্য ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয় ব্যাংকটিকে।
আমানত কমে আসায় তারল্য সংকটের কারণে গত ২৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বছরের সবশেষ কার্যদিবসে শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকটি ‘ডিমান্ড প্রমিজরি নোট’ এর বিপরীতে বিশেষ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ পরিমাণ অর্থ নিয়েছিল।
সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সিআরআর ও এসএলআর জমার হার সংরক্ষণে ঘাটতির কারণে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশকে (আইবিবিএল) টাকা ধার দেওয়া হয়েছিল। পরের কার্যদিবসেই সেই আট হাজার কোটি টাকা ব্যাংকটি সমন্বয় করেছে।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম না মেনে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে সম্প্রতি আলোচনায় আসা শরীয়াহভিত্তিক আইবিবিএল বেশ কিছুদিন থেকেই তারল্য সংকটে পড়েছে। এটিসহ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষকও বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণ অনিয়ম ও পর্যবেক্ষক বসানোর খবর প্রকাশের পর গুজব ও গুঞ্জনে গ্রাহকরা আইবিবিএল থেকে আমানত তুলে নিতে থাকলে তারল্য সংকট দেখা দেয়। এতে সিআরআর ও এসএলআর রাখতে গিয়ে চাপে পড়ে ব্যাংকটি। পরে বাধ্য হয়ে গত বৃহস্পতিবার দৈনিক সুদভিত্তিক ঋণ নিতে আবেদন করে ব্যাংকটি, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন করে।
এ বিষয়ে আইবিবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মাওলা এর কার্যালয়ে গিয়ে এবং একাধিকবার ফোনে ও এসএমএসের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদে দৈনিক নূন্যতম ৩ শতাংশ এবং দ্বি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ৪ শতাংশ হারে সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) রাখতে হয়।
এছাড়া আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় ‘বিশেষ বিধিবদ্ধ জমা- এসএলআর’ হিসেবে। এ দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।
বছরের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার এই দুই ক্ষেত্রেই আইবিবিএল এর ঘাটতি দেখা দিলে বিকল্প না পেয়ে সংকট ও জরিমানা এড়াতে ‘ডিমান্ড প্রমিজরি নোট’ ব্যবস্থার আশ্রয় নেয় ব্যাংকটি। এ ব্যবস্থার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয়। ব্যাংকটি ওভারনাইট বা একদিনের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা নেয়।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং নীতিমালায় পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে প্রফিট বা মুনাফা বলে, যার হার বছর শেষে চূড়ান্ত হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একদিনের জন্য নেওয়া ধারের সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা ছিল র্নিধারিত।
নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী সুদ বা নির্দিষ্ট হারে মুনাফার বিপরীতে কোনো ধরনের আমানত সংগ্রহ বা ধার নিতে পারে না শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো।
তবে ইসলামী ব্যাংক সেদিন যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একদিনের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছিল, ওইদিন প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য কলমানিতে ওভারনাইট বা একদিনের জন্য সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৬ দশমিক ২৫ টাকা, ৩ দিনের জন্য ৮ টাকা আর চার দিনের জন্য ৮ দশমিক ৯৫ টাকা।
তারল্য সংকটে পড়ে ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকের চেয়ে বেশি সুদেই অর্থ ধার নিয়েছিল। এছাড়া আর কোনো বিকল্পও ছিল না অনেক সূচকেই বৃহত্তম এ বেসরকারি ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ধার করার অন্য পদ্ধতিটিও ব্যাংকটি আগে নিয়ে ফেলে। যেমন সুকুক বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়ার সুযোগ আগেই ব্যবহার করে ব্যাংকটি।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকের মত রেপোতে ধারের সুযোগ নেই শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর। যে কারণে ‘ডিমান্ড প্রমিজরি নোট’ নেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না ব্যাংকটির।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দেশে প্রথমবারের মত ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর কলমানি মার্কেট থেকে ধার নেওয়ার সুবিধা দিতে ‘ইসলামিক ব্যাংকস লিক্যুডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ)’ নামে তহবিল চালু করে। সরকারের ইসলামিক সুকুক বন্ডে (বিজিআইএস) থাকা বিনিয়োগ জামানত হিসেবে রেখে এ তহবিল থেকে অর্থ ধার নিতে পারবে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো। তবে এ বাজার থেকেও ধার নেওয়ার সক্ষমতা বা সীমাও শেষ হয় ইসলামী ব্যাংকের।
এদিকে গত ডিসেম্বরে আসা রেমিটেন্সের একটি অংশ বিক্রি করে রোববার নগদ টাকা সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধার ফেরত দেয় ইসলামী ব্যাংক বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
এর আগে তারল্য সংকটে পড়ে সুদহার বাড়িয়ে ৮ শতাংশে আমানত পেতে এক করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তাব দেয় ঋণ অনিয়মের ঘটনায় আলোচনায় থাকা ইসলামী ব্যাংক ব্যাংলাদেশ।