বাঙালির রসনাবিলাস আর মিষ্টির প্রতি সুমিষ্ট আবেগকে বাঙালি নারীর রন্ধনশৈলী করে তুলেছিলো শিল্প; আর সে শিল্পই পিঠেপুলি। পিঠেপুলি ছাড়া বাঙালির শীতকাল শীতকাল আমেজটাই ঠিক আসে না। আমাদের শীতকাল মানেই নলেন গুড় আর চালের গুঁড়োর জম্পেশ কেমিস্ট্রি। কেমিস্ট্রি জমে ক্ষীর! আরে মশাই ক্ষীর তো হবেই, নইলে পাটিশাপটা টা বানাবেন কীভাবে?
‘পিঠে/পিঠা’ শব্দখানা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পিষ্টক’ থেকে। পিষ ক্রিয়ামূলের সাথে ক প্রত্যয় যুক্ত হয়ে পিষ্টক শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীনকালে আর্যরা যখন ধানসহ নানাধরনের শস্য পাথরের সাহায্যে কুটতে আরম্ভ করে, ঠিক সেরকম সময়েই পিঠের জন্ম। বৈদিকযুগে ‘পুরোডাশ’ নামে এক ধরনের পিঠের উল্লেখ পাওয়া যায় যেগুলো ব্যবহৃত হতো যজ্ঞে। মহাভারতের আদিপর্বে বক রাক্ষসকে বধের প্রাক্কালে ভীম ভোজন করেছিলেন পিঠে ও পায়েস। রামায়ণে নারকেল পুলি, কলাবড়া, গুড়পিঠে প্রভৃতির উল্লেখ অত্যন্ত স্পষ্ট। অন্নদামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল থেকে মলুয়ার পালা কিংবা মৈমনসিংহ গীতিকার পালা সবখানে পিঠেপুলি স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
পিঠে নিয়ে অনেক তো বললুম, কিন্তু এই পুলিটা আবার কি – প্রশ্ন জাগতেই পারে। সমস্ত পিঠে,পুলি না হলেও সমস্ত পুলি কিন্তু পিঠেই বটে। ধাঁধার মতো শোনালো? হিসেব কিন্তু বেশ সোজাসাপ্টা। চালের গুঁড়োর মাঝে নারকেল কিংবা ক্ষির সন্দেশের পুর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি দেয়া হয় – এটাই পুলি। পুলির রয়েছে রকমফের। ভাজাপুলি, ভাঁপাপুলি, দুধপুলি, রসপুলি, চন্দ্রপুলি, নারকেল পুলি, রাঙাআলুর পুলি। রসপুলিতে খেঁজুর রস আর দুধ মিশিয়ে যে পুর দেওয়া হয় তা ভোজনরসিক বাঙালির জিভে জল আনবেই। এখন রাঙাআলুর পুলি নতুন করে সমাদর পাচ্ছে। রাঙাআলু খেতে যেমন খাসা তেমনি ক্যান্সার প্রতিরোধে এর জুড়ি মেলা ভার। পুলি এতই জনপ্রিয় পিঠে যে এটিই পিঠের সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নবান্ন কিংবা পৌষ সংক্রান্তির মুখ্য নায়িকা যদি চালের গুঁড়ো হয় তাহলে নায়কের ভূমিকাখানা দিতেই হয় খেঁজুরের রস বা পাটালিকে। পৌষ-অগ্রহায়ণ মাসে নতুন আমন ধান ঘরে তোলেন কৃষক। এ ধান নিয়ে কৃষকের ঘরে ঘরে তৈরি হয় উৎসবের আমেজ। খাওয়া হয় নতুন ধানের পিঠা। আর পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয় পৌষের যাবার বেলায়। পৌষের শেষ সূর্যে বাঙালি মায়েরা বসেন পৌষ সংক্রান্তির পিঠে তৈরিতে। চিতই পিঠে তৈরি হয় নতুন আমন ধানের চাল দিয়ে। চিতই পিঠের সঙ্গে সরিষা ভর্তা, শুটকি ভর্তা, ধনেপাতা বাটা যেমন মানানসই তেমনি চিতই, দুধ আর খেঁজুর পাটালির জুড়ি একেবারে অনবদ্য।
কথায় আছে পান, পানি, পিঠা - শীতকালে মিঠা। কিন্তু একবার ভাবুন তো খেঁজুর রস আর খেঁজুর গুড় না থাকলে বাঙালির ভাবালুতাই কি পিঠেকে মিঠে করতে পারতো? ঝোলাগুড়ের বিবিখানা, মালপোয়া, পাটিশাপটা, খেঁজুরগুড়ে ভাপা পিঠে – এসমস্তই খেঁজুর গুড়-পাটালি ছাড়া আকাশ কুসুম কল্পনার মতোন। বাংলাদেশের ফরিদপুর, যশোর, মানিকগঞ্জ,মেহেরপুর প্রভৃতি জেলা খেঁজুর গুড়ের জন্য প্রখ্যাত।
অঞ্চলভিত্তিক পিঠের মধ্যে সিলেটের ‘চুঙ্গাপুড়া’ পিঠে বিলুপ্তির পথে। চুঙ্গাবাঁশের মধ্যে কলাপাতা বিছিয়ে তার ভেতর ভেজানো বিন্নি চাল পুরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় এ পিঠে। খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠে হচ্ছে ‘হাত-সেমাই’ পিঠে। এছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠে হচ্ছে ‘বিন্নি মধু’ যেটিতে নারকেল, কলা, বিন্নি চাল, চিনি প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়।
মাঘ পেরোলেই ফুরোয় শীত। শুধু ফুরোয় না বাঙালির পিঠের প্রতি আবেগ। শুরু হয় অপেক্ষা; নতুন বছরের, নতুন শীতের, নতুন আমন ধানের আর নলেন গুড়ের। শীত আসে-যায়, বাঙালী পিঠে-পুলিকে ভোলে না, ভুলতে পারে না। যতদিন থাকবে বাঙালি, ততদিন থাকবে পিঠে পুলি।
অনুস্কা ব্যানার্জী (শ্রাবস্তী)ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।