জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
তাকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে শফিকুরের এবং তিনি জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ছেলেকে সহযোগিতা করে আসছিলেন।
শফিকুরের ছেলে রাফাত সাদিক সাইফুল্লাহকে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত ৯ নভেম্বর সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি এখন রয়েছেন কারাগারে। জামায়াত আমির শফিকুরকেও গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
জামায়াতে ইসলামী তাদের আমিরের জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এই অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। কোনো গোপন সংগঠনের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
বেশ কয়েকজন তরুণের ঘর ছাড়া তদন্তে নেমে সম্প্রতি র্যাব নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার কথা জানায়।
ওই জঙ্গি সংগঠনের ‘ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য’ সিলেট থেকে আসা তিন জনকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়।
গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিলেট অঞ্চলে ‘তাদের নেতা’ ডা. রাফাতকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
তার এক মাস পর যাত্রাবাড়ী থানার সেই মামলায় মঙ্গলবার ভোররাতে ঢাকায় বাড়ি থেকে সিটিটিসির অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় জামায়াত আমির শফিকুরকে।
এরপর দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আসেন সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, “জামায়াত আমির তার ছেলে রাফাত নতুন জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়েছেন, এটা জেনেও সমর্থন দিয়ে গেছেন। পরে রাফাত সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।”
‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় জড়ানো অনেকেই রাফাতের মতো জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা ও কর্মী ছিলেন জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, “তাদের হিজরতের খরচও দিয়েছেন জামায়াত আমির।”
তিনি বলেন, “যাদের আমরা গ্রেপ্তার করেছি, তারা সবাই ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য হিজরত করেছিলেন।
“তারা প্রত্যেকেই শিবিরের সাথী ছিলেন। সহযোগী আরিফও শিবিরের সাথী ছিলেন। জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দেওয়ার আগে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সিলেট অঞ্চলের প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেছেন। এরপর নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াত পেয়ে দলসহ যুক্ত হন তিনি।”
আসাদুজ্জামান বলেন, “ডা. রাফাতের নেতৃত্বেই প্রথম সিলেট থেকে ১১ জন বান্দরবানে হিজরত করেন। সেখানে ‘কুকিচিন’ (বম পার্টি নামে পরিচিত পাহাড়ি দল) নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।
“রাফাতের মতো বড় সহযোগী ও সংগঠক তাহহিয়াত। তাহহিয়াতের নেতৃত্বে অনেকে হিজরত করে। তিনি কুকিচিনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।”
সিটিটিসি প্রধান বলেন, “রাফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি, তার বাবা জামায়াত আমির শফিকুর রহমানের সম্মতিক্রমেই ২০২১ সালের জুন মাসে বান্দরবান থেকে ফিরে আসেন তিনি। ডাক্তার শফিকুর রহমানের সিলেটের বাসায় বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন রাফাত।
“১১ ছেলেসহ রাফাত যে হিজরত করেছেন এর সবই জানতেন জামায়াত আমির। ক্ষেত্র-বিশেষ তিনি সহযোগিতাও করেছেন। কুকিচিনে হিজরতের যাবতীয় ব্যয়ভারও তিনি বহন করেছিলেন।”
ডা. শাকের নামে আরেকজনকে কয়েকদিন আগে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, তিনি ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াতি শাখার প্রধান ছিলেন। এই সংগঠন থেকে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক সহযোগিতাই তারা পেতেন। যারা রাফাতের সঙ্গে হিজরত করেছেন তারাও জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সঙ্গে জামায়াতের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও সমর্থন ছিল কি না, তা জানতে এবং এই মামলায় জামায়াত আমিরের সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সিটিটিসি প্রধান জানান।
শফিকুরকে আটকের পর তাকে যাত্রাবাড়ী থানার সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নেয় পুলিশ। পরে তার ৭ দিন রিমান্ডের আদেশ হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, “গ্রেপ্তার এড়াতে ছেলেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করেছেন জামায়াত আমির। আরও কয়েকজনকে তিনি সহযোগিতা করেছেন। জামায়াত ও শিবিরের সঙ্গে নতুন জঙ্গি সংগঠনের আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতে পারে।
“অথবা সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে থাকতে পারে। নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের যাদের গ্রেপ্তার করেছি, তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছি।”
কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট থেকে জঙ্গিদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, “কুকিচিনের কাউকে আমরা এখনও গ্রেপ্তার করতে পারিনি। কুকিচিনের সঙ্গে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সমর্থন এবং সহযোগিতা পেয়ে আসছে বলে আমরা জানতে পারছি।”
আমির ছাড়া নতুন জঙ্গি সংগঠনে জামায়াতের অন্য কোনো নেতার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জামায়াত আমিরের ছেলেই প্রথম হিজরতকারী। তার নেতৃত্বেই একটি বড় অংশ হিজরত করেছে। যে সংগঠনের আমিরের ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে হিজরত করে সেই সংগঠনের অন্য আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতাদের সমর্থন সহযোগিতা ছিল বলে জেনেছি, তথ্যও পেয়েছি।”
এদিকে শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, “আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কোনো গোপন সংগঠনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক, সংশ্লিষ্টতা নেই। জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রাজনীতি করে। ডা. শফিকুর রহমানের সকল তৎপরতা প্রকাশ্য।”
সরকার পতনে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের যে ১০ দফা কর্মসূচি দিয়েছে, তাকে বাধাগ্রস্ত এবং শফিকুরকে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেন মুজিবুর।
তিনি রিমান্ড বাতিল করে অবিলম্বে দলের আমির শফিকুরের মুক্তি দাবি করেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।