‘আলো আলো, আরো আলো- এই নয়নে প্রভু ঢালো’- রবি ঠাকুরের গানের এই আলোর আকুতিই যেন দীপাবলির মধ্য দিয়ে উৎসারিত হয়।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম উৎসব কালীপূজার অঙ্গ হচ্ছে ‘দীপাবলি।’ শব্দটি দ্বারা প্রদীপের সমাহারকে বোঝায়। সেই সমাহারের ফলে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে ঘরের আঙ্গিনায়, তাতে সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোকময় সময়ের সূচনা হবে- এ আশাই থাকে সব বয়সের উদযাপনকারীদের হৃদয়ে।
শ্রীমঙ্গল শহরের বাসিন্দা, অ্যাথলেট মভি সূত্রধর দীপাবলি নিয়ে নিজের ধারণা জানাতে গিয়ে বলেন, উৎসব মানেই যেন মন্দকে ভালোর জয় করার প্রয়াস।
“হিন্দু পরিবারে বেড়ে ওঠায় দীপাবলির উৎসব নিয়মিত পালন করা হয়। এ দিনে সাধারণত পরিবারের সবাই মিলে সন্ধ্যাবেলা মাটির প্রদীপ দিয়ে সারা ঘর আলোকিত করি। আমি মনে করি, প্রতিটি সার্বজনীন উৎসব মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর জয়কে উদযাপন করে।”
“আলোকসজ্জার এই দিবসটি অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলো জ্বালার দিন। আধ্যাত্মিকতার গভীর দর্শনে এই দিন নিজের আত্মাকে প্রজ্জ্বলিত করে পরিশুদ্ধ করার দিন। তবে সবচেয়ে ভালোলাগার বিষয়টি আসলে চারদিকে প্রদীপের আলোর শিখায় আলোকিত দৃশ্য, যা কিনা আমাদের মনে এবং চোখের দেখায় আলাদা একটা প্রশান্তি এনে দেয়,” মন্তব্য করেন মভি।
নটরডেম স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক তিথি দেব পূজা প্রতিবারের মতো এবারও উদযাপন করবেন দীপাবলি
“প্রতি বছর বেশ আনন্দ-উল্লাসের সাথেই দীপাবলি পালন করি আমি। সন্ধ্যাবেলা প্রথা অনুযায়ী সারা বাড়িতে মঙ্গলদীপ প্রজ্জ্বলন করি। ছাদের আশেপাশে জ্বালাই মোমবাতি। আর তারপর একান্তে ছাদে বসে সন্ধার আতশবাজি উপভোগ করি। অন্ধকারে রাতের আকাশে এতো এতো আলো ভালো লাগে।”
তবে বড় হবার সাথে সাথে অন্য উৎসবের মতো দীপাবলির উচ্ছ্বাসেও কিছুটা পার্থক্য এসেছে তার মতে।
"আগে আমিও আতশবাজিতে যোগ দিতাম, এখন আর দেয়া হয় না। এখন বিষয়গুলো দূর থেকে চুপচাপ বসে উপভোগ করি। তবে এবার ভাবছি, দুটো ফানুস ওড়াব।"
দীপাবলির প্রচলন হয় রাম-সীতা-লক্ষ্মণের ১৪ বছর দীর্ঘ বনবাসের সমাপ্তি উৎসব হিসেবে। রামায়ণে তাই প্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায়। করোনা মহামারি, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলা এসব নিয়ে একটা গুমোট ভাব ছড়িয়ে আছে সবদিকে।
রামায়ণের সেই বনবাস শেষের দিনের সাথে আমাদের বর্তমানকে মিলিয়ে দিয়ে তিথি বলেন, “শ্রী রামচন্দ্র সীতা মা-কে অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে আসায় যেমন ঘরে ঘরে জ্বলেছিল প্রদীপ, দূর হয়েছিল নিরাশার অন্ধকার, তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমাদের মনের সকল কালিমা, সকল অপ্রাপ্তি, নিরাশার অন্ধকার দূর করে নতুন উদ্যমে, নতুন আশায় জ্বালানো উচিত এই প্রদীপ। এই আলোয় সবাই ফিরে পাক নতুন প্রাণ।"
গুগলের উপহার
ডিজিটাল যুগে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী গুগল নামের সার্চ ইঞ্জিনটি প্রতিটি বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলে না। দীপাবলির ক্ষেত্রেও ঘটেনি ব্যতিক্রম। গুগল ডুডল হিসেবে তো ছেলেবুড়োর হাসি-আনন্দে মশগুল প্রদীপ আর তারাবাতি প্রজ্জ্বলনে দৃশ্য আঁকা হয়েছেই, সেইসাথে যোগ হয়েছে আরেকটি চমক।
আপনি যদি গুগলে আজ সার্চ করেন ‘দীপাবলি’ শব্দটি, তবে দেখা পাবেন ছোট্ট মিটমিটে একটি প্রদীপের। আগ্রহ ভরে তাতে ক্লিক করলেই দৃশ্যপট বদলে যাবে। অন্ধকার ছায়ায় ভরে যাবে সব হরফ। দেখা যাবে, তাতে জায়গা করে আছে আরো আটটি নেভা প্রদীপ।
প্রথম পাওয়া প্রদীপটি তাদের সবকয়টায় ছোঁয়ালেই অন্ধকার সরে গিয়ে আলোকময় হবে স্ক্রিন। এছাড়া ‘গুগল আর্ট অ্যান্ড কালচার এক্সপেরিমেন্ট’ এর অংশ হিসেবে সুযোগ রয়েছে দীপাবলির সাথে সম্পর্কিত বেশ কিছু ছবি রং করারও।
দূষণের ভোগান্তি
সব ভালোর মাঝে হয়তো কিছুটা ‘কালো’ লুকিয়ে থাকে। উদযাপনের আমেজ যখন আনন্দের তীব্রতায় অন্যের ভোগান্তির কারণ হয়ে ওঠে, তখন কিছুটা হলেও ম্লান মনে হয় উৎসবের পেছনের আন্তরিকতাকে।
পাড়া-মহল্লায় বাজি, পটকা, আতশবাজি, ইত্যাদি বেপরোয়াভাবে পোড়ানোর ফলে বয়োজ্যেষ্ঠ বা অসুস্থ ব্যক্তিরা অস্বস্তি বোধ করেন, হঠাৎ করে চমকানোর ফলে হৃদরোগীদের জন্য বাড়তি সমস্যা সৃষ্টি হয়, শিশু-কিশোরেরাও মেতে থাকে দিনভর।
তাদের অভিভাবকরা যদি এ বিষয়ে সচেতন হোন এবং একটা নিরাপদ জায়গা ও নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে দেন, তাহলে হয়তো কোনো দুর্ঘটনাও ঘটবে না আর অন্যদের ভোগান্তিও হবে না।
শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অদ্রি বর্মন এই ভোগান্তির আরেকটি দিকও চিহ্নিত করেন।
“শুধু মানুষই নয়, পশুরাও এ ভোগান্তির শিকার হয়। পাড়ার শিশুরা কখনো কখনো কুকুরের লেজে বেঁধে বা তাদের গায়ে বাজি ফুটিয়ে উল্লাস করে। এমন নিষ্ঠুর আচরণে নিরীহ পশুরা কতটা কষ্ট পায়, সেটি তাদের বোঝাতে হবে অভিভাবকদেরকেই।”
নিজেকে ও অন্যকে নিরাপদ রেখে, উৎসবের আনন্দকে অন্য কারো সমস্যার কারণ না করে তোলার মাধ্যমে উদযাপিত হোক দীপাবলির মতো সকল শুভ উপলক্ষ। শান্তির আলোকধারায় পরিপূর্ণ হোক আমাদের হৃদয়।
অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।