নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো ঠিকঠাক শর্ত পালন করছে কিনা, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তার তদারকিতে নামছে নির্বাচন কমিশন।
কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ে দলের অফিস; নির্বাচিত কমিটি এবং সব স্তরে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা– তা জানতে চেয়ে নিবন্ধিত দলগুলোর কাছে হালনাগাদ তথ্য চেয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
ত্রিশ কার্য দিবসের মধ্যে এ বিষয়ে কমিশনকে তথ্য দিতে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ইসির উপ সচিব আব্দুল হালিম খান জানান, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কমিশন নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন নিচ্ছে; পাশাপাশি নিবন্ধিত পুরনো দলগুলোর কাছে তথ্য চাইছে।
নির্বাচনী আইনের ক্ষমতা বলে ইসি সময়ে সময়ে দলগুলোর কাছে যে কোনো তথ্য চাইতে পারে। যেসব শর্ত মেনে দলগুলো নিবন্ধন পেয়েছিল, তা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কিনা, তা যাচাই করতে পারে ইসি।
দলগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার পর তা কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান ইসির এ কর্মকর্তা।
নবম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালে দল নিবন্ধনের এ নিয়ম চালু করে ইসি। গত এক যুগে ৪৪টি দল কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। বর্তমানে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৩৯টি।
২০১৭ সালে নিবন্ধিত দলগুলোর কমিটি ও অফিসের খোঁজে মাঠে নামে ইসি। শর্ত পালনে ব্যর্থ দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া ৫ দল
নিবন্ধন শর্ত প্রতিপালন না করায় একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন এবং ভোটের পরে ২০২০ সালে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি-পিডিপি, ২০২১ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার নিবন্ধন বাতিল করে ইসি।
মাঠ পর্যায়ে যাচাই করে ফেরদৌস কোরেশীর দল পিডিপির কেন্দ্রীয় দপ্তর এবং জেলা ও উপজেলা দপ্তরের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা পায়নি ইসি।
শফিউল আলম প্রধানের জাগপার পক্ষ থেকে স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, এক তৃতীয়াংশ জেলা, ১০০ উপজেলা/থানায় তাদের কোনো দলীয় কার্যালয় নেই। ১০০টি উপজেলায় ২০০ জন ভোটার সদস্যও তাদের নেই।
আর কাজী ফারুকের ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলনের কাছে কমিশন যেসব তথ্য চেয়েছিল তা দিতে ব্যর্থ হয় দলটি।
২০০৮ সালে শর্তসাপেক্ষে নিবন্ধন পেলেও স্থায়ী সংশোধিত গঠনতন্ত্র দিতে না পারায় নবম সংসদ নির্বাচনের ২০০৯ সালে ফ্রিডম পার্টির নিবন্ধন বাতিল হয়।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন আদালত অবৈধ ঘোষণা করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ইসির প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়, আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় আরপিও অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হল।
কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে দল নিবন্ধনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে। সেক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার আগেই নতুন কোনো দল নিবন্ধন পাবে কি না এবং পুরনো কোন দল নিবন্ধন হারাবে কি না– তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই (দলগুলোকে) চিঠিপত্র দেই; কিছু তথ্য দেন। আমরা কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য পাঠাই, তারা যাচাই করে আমাদের পাঠায়। যিদি সবগুলো (দলগুলোর নিবন্ধনশর্ত প্রতিপালন) তথ্য ঠিক থাকে, তাহলে তো নিবন্ধন টিকে যায়।”
শর্ত ঠিকভাবে প্রতিপালন না করলে, যাচাই বাছাইয়ের পর সঠিক তথ্য না পেলে কমিশন পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেবে বলে জানান তিনি।
৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব কতদূর
নিবন্ধিত দলের সব স্তরে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিবন্ধিত কোনো দল তা পূরণ করতে পারেনি।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের ভাষায়, এটা বাস্তবতা; আর কিছু ক্ষেত্রে ‘বাস্তবতা বিবেচনা’ করতে হয়।
“না হলে তো সব দলের নিবন্ধন যাবে। এ বিষয়টা যারা আইনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তারা বাস্তবতা বিবেচনা করেননি।”
বর্তমান কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে দলের সব স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার শর্ত পূরণের সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
দলগুলো ‘আন্তরিকভাবে’ চেষ্টা করলে ওই সময়ের মধ্যে এ শর্ত পূরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন আলমগীর।
সাবেক এ সচিব বলেন, ইসির যে জনবল রয়েছে, তা দিয়ে ‘ইনটেনসিভলি’ তদারকির কাজ চাইলেও করা যায় না।
“আমাদের সক্ষমতা দেখতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী ইসির অন্যতম চারটি কাজ। পরবর্তীতে বিশেষ সময়ে অনেক কাজ দেওয়া হয়েছে; এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, তাদের তদারকি এসেছে। এ জন্যে আলাদা উইং, লোকবল বৃদ্ধি হয়নি। এসব দেখতে যে জনবল দরকার, সাংগঠনিক শক্তি থাকা দরকার, সেটা তো নেই আমাদের।”
হরেক নামে আগ্রহী ৪০ দল
সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৭৬টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও ২০১৮ সালে একটিও নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হয়নি।
আগ্রহী দলগুলো শর্ত পূরণ করার কথা বললেও যাচাই-বাছাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তবে ভোটের পরে আদালতের আদেশে নিবন্ধন পেয়েছে দুটি দল।
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তত ৪০টি দল নিবন্ধন চেয়ে ইসিতে আবেদন করেছে।
আগ্রহী দলগুলো হচ্ছে- নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টি, মুসকিল লীগ, নতুন বাংলা, বঙ্গবন্ধু দুস্থ ও প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (পিডিএ), বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি (বিআরপি), বৈরাবরী পার্টি, বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দল, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ আম জনতা পার্টি, বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট (বিডিএম), বাংলাদেশ তৃণমূল জনতা পার্টি (বাংলাদেশ টিজেপি), আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টি, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল গ্রীন পার্টি, বাংলাদেশ সার্বজনীন দল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ, গণ রাজনৈতিক জোট-গর্জো, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), নতুন ধারা বাংলাদেশ-এনডিবি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় দল, কৃষক শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ তৃণমূল লীগ ইত্যাদি।
নতুন দল হিসেবে নিবন্ধিত হতে হলে একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়, দেশের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর কমিটি এবং সদস্য হিসেবে অন্তত ১০০টি উপজেলা/মহানগর থানায় প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থন সম্বলিত দলিল থাকার শর্ত পূরণ করতে হয়।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, “নতুন দল নিবন্ধন চলমান প্রক্রিয়া। শর্ত পূরণ করেছে কিনা, গঠনতন্ত্র ঠিক আছে কিনা- সব ঠিক থাকলে নিবন্ধন পাবে। শর্তপূরণ করতে না পারলে নিবন্ধন পাবে না।
এবার আগ্রহী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতের সাবেক নেতাদের সম্পৃক্ততা থাকায় বিডিপি ও এবি পার্টি আলোচনায় রয়েছে।
দলের গঠনতন্ত্র দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন, এ দলটি থেকে ছুটে আসাদের দুটি নতুন দল গড়ে নিবন্ধন চাওয়ার প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, গঠনতন্ত্র সংবিধান পরিপন্থি হলে এই দলগুলোও নিবন্ধনের সুযোগ পাবে না।