সাধারণত একটি স্থানে ভূমিকম্প হলে এর উৎপত্তিস্থলের ভূ-উপরিভাগের অংশটি ‘এপিসেন্টার’ বা ‘উপকেন্দ্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে সোমবার তুরস্কের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা একে ‘এপিসেন্টার’ নয় বরং ‘এপি-লাইন’ বা ‘উপ-রেখ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
রয়টার্স জানায়, সোমবার ভোরে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। প্রবল শীতের মধ্যে ভোররাতে হওয়া এ ভূমিকম্পে প্রতিবেশী সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও সাইপ্রাসও কেঁপে ওঠে। অঞ্চলটির অধিকাংশ মানুষই তখন ঘুমিয়ে ছিলেন।
ভূমিকম্পে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার। শুধু তুরস্কেই ধসে পড়েছে সাড়ে ৩ হাজার ভবন।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটি আঘাত হানার পর এর যে ‘আফটারশক’ বা পরাঘাত তার মাত্রাও ছিলো ৭ দশমিক ৫। একে আরেকটি ভূমিকম্পই বলছেন তুরস্কের কর্মকর্তারা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
সিএনএনের আবহাওয়াবিদ ও দুর্যোগকালীন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ চ্যাড মেয়ারস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, কেন এই ভূমিকম্পের পরাঘাতও আরেকটি ভূমিকম্পের মতো শক্তিশালী হয়েছে।
তিনি বলেন, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ‘আফটার শক’টি নিজেই আরেকটি ভূমিকম্প। ওই অঞ্চলে ১৯৯৯ সালের পর এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার ঘটনা।
“আমরা সাধারণ উপকেন্দ্রের (পৃথিবীর কেন্দ্রে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের বিবেচনায় ভূপৃষ্ঠের যে স্থান) কথা বলে থাকি, কিন্তু এই ভূমিকম্পের বেলায় আমাদের একে ‘উপ-রেখ’ বলা উচিৎ।”
পৃথিবীর ভূ-ভাগের বাইরের পৃষ্ঠটি অনেক টুকরো দিয়ে গঠিত, যেগুলোকে টেকটোনিক প্লেট বলা হয়। পৃথিবী সৃষ্টির আদিতে এই প্লেটগুলো একসঙ্গে ছিল, এগুলো ক্রমে সরতে সরতে এখন বিভিন্ন মহাদেশের আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে।
সঞ্চালনশীল এই প্লেটগুলোর সীমানা ‘সিস্টেম অব ফল্টস’ হিসেবে পরিচিত। ফল্ট হচ্ছে দুই প্রস্থ পাথরের মধ্যখানের ফাটল বা চ্যুতি। টেকটোনিক প্লেটের এই ফল্টগুলোর হঠাৎ যে কোনো নড়াচড়াই ভূমিকম্পের কারণ।
নিউজউইক জানায়, তুরস্কের ভূতল দিয়ে এমনই দুটি ফল্ট লাইন চলে গেছে যার নাম ‘নর্থ আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন’ ও ‘ইস্ট আনাতোলিয়ান ফল্ট’। তুরস্ক এই দুই ফল্ট লাইনের উপর অবস্থিত হওয়ায় বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
সিএনএনের আবহাওয়াবিদ মেয়ারস বলেন, “অ্যারাবিয়ান ও ইউরেশিয়ান এই দুই বিশাল টেকটোনিক প্লেট তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের ভূ-অভ্যন্তরে মিলিত হয়েছে। এই ‘ফল্ট লাইন’ বরাবর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ১০০ মাইল জুড়ে নড়াচড়া করেছে।”
মেয়ারস জানান, ভূকম্পনবিদরা এই ঘটনাকে একটি ‘স্ট্রাইক স্লিপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যেখানে দুই টেকটোনিক প্লেট পরস্পরকে স্পর্শ করছে, এবং হঠাৎই তারা পাশাপাশি ‘স্লাইড’ করেছে বা পিছলে গেছে।
এটা যুক্তরাষ্ট্রে পশ্চিম উপকূলজুড়ে বিস্তৃত ‘রিং অব ফায়ারে’র মতো নয়। পৃথিবীর ওই অঞ্চলটিতে ভূমিকম্প বা সুনামির কারণ ‘সাবডাকশন’, যেখানে একটি টেকটোনিক প্লেট অন্যটির ওপর উঠে যায়।
কিন্তু একটি ‘স্ট্রাইক স্লিপ’ তখনই ঘটে যখন প্লেট দুটো পাশাপাশি উলম্বভাবে নয় বরং অনুভূমিকভাবে পিছলে যায়।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ভূকম্পন বিশেষজ্ঞ ক্রিস এলডারস নিউজউইককে বলেন, “তুরস্ক ও ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল খুবই নাজুক একটি অবস্থানে রয়েছে। কারণ অ্যারাবিয়ান টেকটোনিক প্লেটটি উত্তর দিকে সরছে এবং এটার সঙ্গে উত্তরে অবস্থিত ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষ হচ্ছে। আর এই দুই প্লেটের অভিঘাতের মাঝখানে তুরস্ক আটকা পড়ে গেছে। দুই প্লেট পাশাপাশি পরস্পরকে ধাক্কা দেওয়ায় তুরস্ক মাঝখানে পড়ে চিপসে যাওয়ার মতো এক পরিস্থিতিতে পড়েছে। আর এটাই এই ভূমিকম্পের কারণ।”
সিএনএনের আরেক আবহাওয়াবিদ ক্যারেন ম্যাগিনিস বলেন, “এই ভূকম্পনের বৈশিষ্ট্যের কারণে আফটার শক পরের কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্তও অনুভূত হতে পারে।”