তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা


এফই অনলাইন ডেস্ক | Published: November 14, 2022 11:33:06 | Updated: November 14, 2022 16:48:51


প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বছর কয়েক ধরে সময়ে সময়ে বড় ঋণ পরিশোধে ছাড় ও সুবিধার পাশাপাশি নানান পদক্ষেপও খেলাপি ঋণের রাশ টানতে জোরালো ভূমিকা রাখছে না; এর মধ্যেই সবশেষ তিন মাসে তা আরও ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়েছে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছি ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশের মত। গত জুন শেষে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ।

এ হিসাবে খেলাপি ঋণের হার আগের প্রান্তিকের চেয়ে গত সেপ্টেম্বর শেষে দশমিক ৪ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে বলে তিন মাস পরপর তৈরি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক জুন শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকায়।

আর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

অপরদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।

সবশেষ খেলাপি ঋণের তথ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক জিএম আবুল কালাম আজাদ এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

নিয়মিত বিরতিতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ‘ভুল’ যায়গায় ঋণ যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন।

তার মতে, “শুধু আইন সংস্কার করলেই হবে না, তা প্রয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারকে কার্যকর ভূমিকাও রাখতে হবে।“

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হবে বলে মনে করেন গবেষক ও অর্থনীতির শিক্ষক সেলিম রায়হান।

তার ভাষ্য, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি হয়ে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর এই নির্বাহী পরিচালকের মতে, ব্যাংকিং খাতের ‘গভীর ক্ষত’ খেলাপি ঋণ কমাতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে আন্তরিকতার প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছে।

“এজন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা প্রয়োজন যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক তার ক্ষমতা প্রয়োগ করবে ও ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে। সরকারকেও ভূমিকা রাখতে হবে।’’

এমন ঋণ কমিয়ে আনতে ‘ইচ্ছেকৃত খেলাপিদের’ বিরুদ্ধে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে নামার পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিনের।

তিনি বলেন, ‘‘তাদের বারবার ছাড় সুবিধা দিয়েও অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। আর যারা নানা কারণে ব্যবসায় লোকসান দিয়েছে বা অনিচ্ছাকৃত কারণে খেলাপি হয়েছে তাদের বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানির সম্পদ, জমি বিক্রি করে হলেও আদায় করা উচিত।’’

এর আগে সরকারের পক্ষ থেকেও বারবার খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে নানান পদক্ষেপের কথা বলা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের খেলাপি ঋণ ‘এক টাকাও বাড়বে না’ বলে আগাম জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ব্যাংক মালিকরা তাকে কথা দিয়েছেন বলে তিনি তখন বলেছিলেন।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে আগের ধারাবাহিকতায় নিয়মিত বিরতিতে খেলাপি ঋণ বাড়তে দেখা গেছে। ওই বছরের মার্চেই দেশে প্রথমবারের মত খেলাপি ঋণ ছয় অঙ্কের ঘর পেরিয়ে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা হয়েছিল।

পরে খেলাপিদের বিশেষ ছাড় ও ২ শতাংশ এককালীন পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে খেলাপির পরিমাণ কিছুটা কমে হয় ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।

এরপর কোভিড মহামারীসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে নানান ছাড় দেয়। এতে করে এক বছর পর ২০২০ সাল শেষে তা আরও কমে দাঁড়িয়েছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ওই বছরে মহামারীর কারণে ঋণের কিস্তি পরিশোধে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি বকেয়া হলেও খেলাপি না দেখানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংক্রমণ পরিস্থিতি কমে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে থাকলে এরপর সুবিধা ধীরে ধীরে তুলে নেয়া শুরু হয়। যার ফলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের স্থিতি ফের লাখ কোটির ঘর পার করে হয় ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে চলতি বছরের প্রতি প্রান্তিকেই তা বাড়তে দেখা গেছে।

এর মধ্যে নতুন গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদার গত ১৮ জুলাই খেলাপি হওয়া ঋণের পুনঃতফসিল ও পুনঃর্গঠনের বিষয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এখন থেকে কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিটি ব্যাংক ঋণ পুনঃর্গঠন ও পুনঃতফসিলের নীতিমালা করবে। এ সার্কুলারের ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনঃর্গঠনে বড় ছাড়ও দেওয়া হয়।

এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপির পরিমাণ কাগজে-কলমে আরও কমে আসবে বলে মনে করেছিলেন বিশ্বেষকরা; তবে গত সেপ্টম্বর প্রান্তিক শেষে তা হয়নি।

আগের মত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেই বেশি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৩ শতাংশের আশেপাশে।

এর আগের তিন মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার মত। গত জুন শেষে এগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।

অপরদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আগের তিন মাসের চেয়ে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে সাড়ে ৬৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির হার দাঁড়িয়েছে সোয়া ৬ শতাংশের মত।

এসব ব্যাংকে জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। তখন খেলাপির হার ছিল ৬ দশমিক শুন্য ১ শতাংশ।

এছাড়া বিশেষায়িত তিন সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা বিতরণ করা ঋণের পৌনে ১২ শতাংশের মত। আর বহুজাতিক ৯ ব্যাংকে এসময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকার, যা ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের পৌনে ৫ শতাংশের বেশি।

Share if you like