ব্রিটিশ আমলে পহল্লাদ দেবের হাত ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় তিতাস নদীর পাড়ে সলিমগঞ্জ বাজারে গড়ে উঠে 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার'। ১৯২০ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিন প্রজন্মের মালিকানায় টিকে থাকা দোকানটির খ্যাতি রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং নরসিংদী জেলাবাসীর কাছে। দুই টাকা প্রতি কেজি মিষ্টির দর থেকে শুরু হয়ে বর্তমানে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রাধা কৃষ্ণের মিষ্টি। শতবর্ষী 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর সবচেয়ে বিখ্যাত মিষ্টান্ন হচ্ছে ছানার সাদা মিষ্টি। এছাড়া কালো জাম, রসমালাই, পেড়া সন্দেশ, দই, মচমচে নিমকি ও গজাও পাওয়া যায় দোকানটিতে।
মেঘনার মূল প্রবাহ থেকে একটি আঁকাবাঁকা শাখা নদীর পথ ধরে খানিকটা এগুতে থাকলেই দেখা মিলবে সলিমগঞ্জ লঞ্চ ঘাটের। মেঘনা থেকে জন্ম নেওয়া নদীটির নাম 'তিতাস'। তিতাস নামের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামটিই সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ বাংলাদেশে। অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণ তার ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাসের কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাসের কথা বর্ণনা করেছিলেন। আর এই উপন্যাসের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র স্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক তার কালজয়ী সিনেমা 'তিতাস একটি নদীর নাম' তৈরি করেন। সেই তিতাস নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সলিমগঞ্জ বাজার। নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর ও নবীনগর উপজেলার মানুষদের কাছে বাজারটির খ্যাতি রয়েছে শতবর্ষ ধরে। সলিমগঞ্জ বাজার নামটির সাথে শতবর্ষী 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
১৯২০ সালে সলিমগঞ্জের পহল্লাদ দেবের হাত ধরে দোকানটি গড়ে উঠে। শুরুতে পহল্লাদ দেবই ছিলেন কারিগর এবং বিক্রেতা। তার কাছ থেকেই মিষ্টি বানানোর কাজ শিখেন তার পুত্র প্রাণধন দেব। প্রাণধন দেবের মৃত্যুর পর দোকানটির দায়িত্ব বুঝে নেন তার পুত্র খোকন দেব। বর্তমানে খোকন দেবই 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর মালিক। তিনি একইসাথে কারিগর, সার্ভিস ম্যান এবং ম্যানেজার। খোকন দেবের সাথে আরও কয়েকজন তরুণ কারিগর কাজ করেন এবং তার কাছ থেকে তালিম নিয়ে তারাই মূলত মিষ্টি বানানোর কাজ করেন।
'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর সবচেয়ে জনপ্রিয় মিষ্টিটি শতভাগ ছানা দিয়ে তৈরি করা হয়। এলাকাবাসী এটিকে ছানার সাদা মিষ্টি বলে থাকেন। ছানার সাদা মিষ্টিটি কয়েকটি প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়। প্রথমে গরুর দুধকে জ্বাল দিয়ে ছানার পানি দিয়ে রেখে দেওয়া হয় এবং ছানা তৈরি করা হয়। ছানাগুলোকে মটে (মেখে মেখে) মিষ্টির আকৃতি দেওয়া হয়। এবং তারপর কাঁচা ছানার মিষ্টিগুলোকে গরম ডুবুডুবু শিরায় ছেড়ে দেওয়া হয়। 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর কিছু সিক্রেট রেসিপি আছে যা শিরার মধ্যে দেওয়া হয়। এভাবেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মিষ্টি বানাতে থাকেন কারিগররা। একদিকে মিষ্টি তৈরি হয়, অন্যদিকে গরম গরম মিষ্টিগুলো সাথেসাথেই বিক্রি হয়ে যায়।
গ্রামীণ উৎসব এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের মৌসুমে মিষ্টির চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। এসময় দুপুর বা বিকেলের আগেই মিষ্টি শেষ হয়ে যায়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মিষ্টির চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' এর মালিক খোকন দেব। তিনি জানান, 'বছরের বাকি দিনগুলোতে দৈনিক ১০ থেকে ১২ মণ মিষ্টি বিক্রি হয়। উৎসবের দিনগুলোতে ২০ থেকে ৩০ মণ মিষ্টি বিক্রি করতে পারি আমরা। উৎসবে ৫০ থেকে ৬০ মণ মিষ্টির চাহিদা থাকলেও প্রয়োজনীয় দুধ কিংবা কারিগরের অভাবে আমরা এত মিষ্টি বানাতে পারি না'।
দুধের দামের সাথে উঠানামা করে মিষ্টির দাম। আশেপাশের কয়েকটি গ্রাম থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করা হয়। উৎসবের মৌসুম ছাড়া দুধের দাম কম থাকায় মিষ্টির দামও কম রাখা হয়। তবে গত কয়েকমাস ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত উঠানামা করছে 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' এর জনপ্রিয় ছানার সাদা মিষ্টির দাম।
রাধা কৃষ্ণের মিষ্টির দোকানে আশেপাশের কয়েকটি উপজেলার মানুষের সমাগম হয় প্রতিদিন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই মোটরসাইকেলে চড়ে আসেন এবং ১০ থেকে ১২ কেজি মিষ্টি কিনে সাথে নিয়ে যান। এমন একজন ক্রেতা বলেন, “এখানকার ছানার মিষ্টিটি মুখে দেওয়ার মাত্রই মিশে যায়। এমন সুস্বাদু মিষ্টি আমি কোথাও খাইনি। তাই ইচ্ছে হলেই সরাসরি দোকানে এসে এক বসায় ১০ থেকে ১২টি মিষ্টি খাওয়া হয় এবং পরিবারের জন্য সাথে করে নিয়েও যাওয়া হয়”।
তবে একসময় 'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর মিষ্টি এত জনপ্রিয় ছিল না। শুরুতে পহল্লাদ দেবের মিষ্টির ব্যবসার প্রতিপক্ষ ছিল সলিমগঞ্জ বাজারেরই গোবিন্দ দেবের মিষ্টি। গোবিন্দ দেব মারা যাওয়ার পর আর কেউ হাল ধরতে না পারায় সলিমগঞ্জ বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে রাধা কৃষ্ণের মিষ্টি।
রাধা কৃষ্ণের মিষ্টি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে সুখ্যাতি থাকলেও বিশ্বায়নের যুগে এই মিষ্টির খ্যাতি ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু রাধা কৃষ্ণের স্বত্বাধিকারী খোকন দেব দেশজুড়ে খ্যাতি পেতে আগ্রহী নন। তিনি বর্তমান অবস্থাতেই ভালো আছেন বলে জানান। তার ভাষ্যমতে গণমাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের প্রচার হওয়ার ফলে তাকে হরহামেশাই ভোগান্তির শিকার হতে হয়। প্রশাসন থেকে ভ্যাটের জন্য চাপ দেওয়া হয় এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মানুষের নজরে আসতে চান না তিনি।
'রাধা কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার' এর সাথে পাল্লা দিয়ে সলিমগঞ্জ বাজারে আরো কয়েকটি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারও গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে শাহজালাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার এবং আল মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টির গুণগত মান ভালো হওয়ায় এলাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে রাধা কৃষ্ণের মিষ্টিই প্রথম অপশন বেশিরভাগ ক্রেতার কাছে। তবে সেখানে মিষ্টি পাওয়া না গেলে শাহজালাল এবং আল-মদিনাতে ভীড় করেন ক্রেতারা। যার ফলে বাকি দোকানগুলোতেও প্রতিদিন মণকে মণ মিষ্টি বিক্রি হয়।
তারেক রহমান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।