Loading...
The Financial Express

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা এই কবরের ইতিহাস জানেন কি?

| Updated: February 17, 2023 14:39:08


কবর ফলক, কার্জন হল (ডানে উপরে) এবং বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মেসি বিভাগ। ছবি: ইউটিউব/অ্যাটলাস অবসকিউরা কবর ফলক, কার্জন হল (ডানে উপরে) এবং বায়োকেমিস্ট্রি ও ফার্মেসি বিভাগ। ছবি: ইউটিউব/অ্যাটলাস অবসকিউরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল কোনো আবাসিক হল নয় তবে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বিষয়গুলোর শ্রেণি কার্যক্রম চলে এখানে 

এখানকার বায়োকেমিস্ট্রি মলিকুলার বায়োলজি কিংবা ফার্মেসী অনুষদ যে ভবনে অবস্থিত, সেখান থেকে একটু সামনে এগোলেই চোখে পড়বে শ্যাওলা পড়া ধূসর এক ফলক জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে লেখা একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে আসলে এটি একটি কবরফলক 

ফলকের নামটা একটু কষ্ট করলেই পড়া যায় মীর আশরাফ আলী মৃত্যুসাল ১৮২৯ সেসময় ভারতে কোম্পানির শাসনেরও অবসান হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল আরো ৯২ বছর পর তার আগে এসব জমি ছিলো জমিদারদের আর তাদেরই একজন ছিলেন মীর আশরাফ আলী 

অবশ্য তাদের একজন না বলে, বলা যায় সে সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী জমিদারই ছিলেন তিনি সত্যি বলতে, অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে ধনী জমিদার ছিলেন মীর আশরাফ আলী এই জমিদারের উত্থান বিস্ময়কর

তার জন্ম ইরানের সিরাজ নামের এক জায়গায় বাবা মীর আলী মাহদী নাম রেখেছিলেন মীর আলী আশরাফ তিনি ১৮০০ খিস্টাব্দে ইরান থেকে ভাগ্যান্বেষী হয়ে আসেন ভারতের এলাহাবাদে তারপর রুটিরুজির খোঁজে পা রাখেন বাংলায়৷ সে সময়ে চলছে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কোম্পানির আস্থাভাজন ঢাকায় নায়েব--নবাব নুসরাত জঙ্গ (বা জং) এরপর নবাব শামস-উদ-দৌলার সভাসদের পদে ঠাঁই পান তিনি

মোটা বেতন পেতে থাকায় বেশ পয়সা জমতে থাকে তার৷ কিনে ফেলতে থাকেন জায়গা-জমি তারপর নিজেই বনে যান জমিদার তার জমিদারি বিস্তৃত হয় ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা-কুমিল্লা, বাখেরগঞ্জ (বরিশাল) চট্টগ্রামজুড়ে সব মিলিয়ে তিন লাখ বিঘা জমি এসে গিয়েছিলো তার কব্জায় পুরোটা অবশ্য চাকরির টাকা থেকে নয় জমিদার হয়ে আলী আশরাফ নিজের নাম করে নিলেন 'মীর আশরাফ আলী' তারপর তার বৈভব উত্তরোত্তর বাড়িয়ে তুলতে থাকলো তার অনুগত লাঠিয়াল বাহিনী 

তবে তিনি তখন নিয়মিতভাবে ঢাকায় থাকতেন না তার এস্টেট প্রতিষ্ঠা করলেন ত্রিপুরার বলদাখাদে; যা বর্তমানে কুমিল্লা জেলার নবীনগর উপজেলায় পড়েছে জমিদারি থেকে বার্ষিক আয় করতেন আড়াই লাখ টাকা নিজের স্থায়ী আবাস ছিলো কুমিল্লার মুরাদনগরে এছাড়া ঢাকার গুলিস্তান চানখাঁরপুল সংলগ্ন ফুলবাড়িয়ায় (এফ এইচ হল এর পেছনে) তার বেশ জমি-জমা ছিলো 

প্রাচুর্য বৈভবে মোড়ানো মীর আশরাফ আলী দিনে দিনে হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর অত্যাচারী মেহেদি আবেদীনের এক লেখা থেকে জানা যায়, নারীলোলুপ আশরাফ আলীর লালসার শিকার হয় সেসময় বহু নারী সম্পত্তি দখলও ছিলো ডালভাতের মতো ব্যাপার 

তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় তার একটি প্রচন্ড অন্ধকার দিক নরখাদক হয়ে উঠেছিলেন তিনি! কীভাবে শুরু তা জানা যায়নি তবে মাঝে মাঝে তার এই 'শখ' গোপনে পূরণ করা হতো

কুমিল্লায় এলাকায় তার বিষয়ে এমন কথা যুগের পর যুগ ধরে ছড়িয়েছে। মেহেদী আবেদীনের লেখায় এসেছে তাকে নিয়ে প্রচলিত তেমন একটি ঘটনার কথা- একদিন তিনি বাবুর্চিকে ডেকে ইচ্ছা পোষণ করেন মানুষের কলিজা খাওয়ার! বিভিন্ন প্রাণিদেরই কলিজা ভুনার স্বাদ বেশ চমৎকার হয়। বাবুর্চির মনে হয়েছিলো, আশরাফ আলী অন্যান্য প্রাণিদের কলিজা যেহেতু মাংসের চেয়েও আগ্রহ নিয়ে খান, সেক্ষেত্রে মানুষের কলিজা তার ভালো লেগে গেলে ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যাবে! প্রচুর মানুষ মারা পড়বেন তখন।

বাবুর্চি কলিজায় অল্প বিষ দিয়েছিলেন। নবাব মুখে নিয়েই থু করে ফেলে দেন। মানুষের কলিজার ওপর থেকে তার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়৷ কিন্তু মানুষের ওপর অত্যাচার ও নরমাংস লোভ বাড়ছিলোই শুধু।  

এরপর একরাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ তার প্রাসাদ ঘিরে ফেলে নবাব এর কিছুক্ষণ আগেই খবর পেয়েছিলেন তিনি দামি সব  অলংকার, প্লেট, বাসন সামনের খালে ফেলে দেন তারপর সপরিবারে পলায়ন বিক্ষুব্ধ জনতা তার মুরাদনগরের প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেয় তবে নবাব গোপনে তার আস্থাভাজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের হাতে মুরাদনগরের জমিদারি ছেড়ে দেন 

এরপর আমৃত্যু তিনি ছিলেন ঢাকাতেই ১৮২৯ সালে তার মৃত্যু হয় সে সময় তার জমিদারি ছিলো পুরো চানখাঁরপুল থেকে ফুলবাড়িয়া তাকে ফুলবাড়িয়া চানখাঁরপুলের কাছাকাছি কবর দেয়া হয় যেটি বর্তমানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সামনে 

তবে অন্য অনেক জমিদারের মতোই ইংরেজ তোষণ ও প্রজাদের শোষণের ব্যাপার সত্য হলেও তার নরখাদক হবার বিষয়টি অনেক গবেষকের কাছেই অতিরঞ্জিত মনে হয়েছে৷ ড. কানিজ-ই-বতুল তার লেখায় এটিকে রটনা হিসেবেই দেখেছেন ও এর তেমন সত্যতা পাননি ঐতিহাসিক সৈয়দ মূহম্মদ তইফুর এর লেখাতেও এই নরখাদক প্রসঙ্গ আসেনিতিনি নবাবের ইংরেজ আনুগত্যের কথা ও কিছু অত্যাচারের কথা উল্লেখ করলেও নরখাদক প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ করেননি

এছাড়া, হেকিম হাবিবুর রহমান পুরান ঢাকা নিয়ে বহুকিছু লিখলেও আশরাফ আলী নরখাদক ছিলেন এমন কিছু উল্লেখ করেননি এটিও প্রশ্ন যে, একজন নরখাদককে ইংরেজরা নায়েবে নাজিমের পদে রাখতো কি না? 

মীর আশরাফ আলী শিয়া সম্প্রদায়ের ছিলেন শাহ আব্দুল আজিজ শিয়া মতবাদের বিরুদ্ধে 'তুহফা-ই-ইসনা আশারিয়া' বইটি লিখলে তিনি এর বিরুদ্ধে কড়া জবাব দেবার জন্য প্রবৃত্ত হন তার নরখাদক হবার বিষয়টি সুন্নি সম্প্রদায়ের ও বিরোধীপক্ষের অপপ্রচার বলে মনে করতেন তার উত্তরসূরিরা 

নবাবের বংশধররা পরবর্তীতে ভালো অবস্থায় ছিলেন না দিনে দিনে তাদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে সূর্যাস্ত আইনের পর তারা দেউলিয়া ঘোষিত হন তবে জমিদারি না থাকলেও তার উত্তরসূরিদের অনেকেই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন ও  বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদসমূহে আসীন হয়েছিলেন 

তার বংশধর সৈয়দ আলী আহমদ ১৯৩০ এর দশকে এই কবরটি চিহ্নিত করেছিলেন তখন আবার নতুন করে ফলক নির্মাণ সংস্কার করা হয়তৎকালীন উপাচার্য আর.সি মজুমদার কবরটি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেন আলী আহমদ ১৯৬৫ সালে মারা যান এরপর তার কবরের খোঁজ নিতে আর কোনো বংশধরকে এদিকে আসতে দেখা যায়নি 

আজ আর নেই তার সেই জমিদারি, বংশধরদেরও আর কোনো খোঁজ নেই তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়ে গেছে তার কবর, প্রজন্মান্তরে মুরাদনগর-নবিনগরের মানুষের কথায়-গল্পে রয়ে গেছে তার নৃশংসতার আখ্যান তবে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই নবাব নরখাদক ছিলেন কিনা তা আজও সুস্পষ্টভাবে মীমাংসিত নয়

মাহমুদ নেওয়াজ জয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন 

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic